জড়বাদ ও আস্তিক্যবাদের মূল্যায়ন।

আজকাল বিজ্ঞানের যুগ; সহজে কেউ আধ্যাত্মিক বিষয়ের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে চায় না; কারণ ইহা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় নহে। যেমন ধরেন, জীবাত্মার ও পরমাত্মার কথা। জীবাত্মাকে আমরা কেহ দেখতে পাইনা, পরমাত্মাকে আমরা কেহ স্পর্শ করতে পারিনা, অর্থ্যাৎ কোন ইন্দ্রিয় দ্বারা আমরা ইহাদিগকে প্রত্যক্ষ করতে পারিনা। সেজন্যই স্বভাবতই আমরা ইহাদের অস্তিত্বে সন্দেহ করিয়া থাকি। তবে বলা বাহুল্য যে, প্রত্যক্ষ দর্শনই জ্ঞান লাভের একমাত্র উপায় নয়, প্রত্যক্ষ না দেখিয়াও আমরা অনেক বিষয় অবগত হয়ে থাকি। আমরা আজকের একবিংশ শতাব্দীতে যারা জন্মেছি, তারা কিন্তু উনবিংশ বা বিংশ শতাব্দীর চিত্র অবলোকন করি নাই, কিন্তু বহু শ্রুত, পুস্তক ও পুরাকীর্তী দেখে আমরা সে সময়ের চিত্র অনুমাণ করতে পারি। সেইরূপ জীবাত্মা ও পরমাত্মা যদিও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু নহে, যদিও আমরা ইহাদিগকে দেখতে বা স্পর্শ করিতে পারিনা, তবুও আমরা বহু সূক্ষ্ম বিচারের মাধ্যমে ইহাদের অস্তিত্ব অনুমাণ করিতে পারি। ঠিক এভাবেই ইশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করা হয়। শাঁখের করাত যেমন দুই দিকেই কাঁটে ঠিক তেমনি অনুমানের দ্বারা স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ অপ্রমাণ দু’টাই করা হয়। আস্তিকরা স্রষ্টার প্রমাণ করতে চায় আর জড়বাদীরা অপ্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর। 



জড়বাদীগণ বলেন যে এই জগতে ইশ্বরের কোনো স্থান নাই। তাহারা বলেন ইশ্বরের প্রয়োজন কি? এই বিশ্ব সৃষ্টির জন্য যদি কোনো সত্বার প্রয়োজন হয়ে থাকে তাহলে অণুপরমাণু কি দোষ করিল? উহাদের সাহায্যেই আমরা সৃষ্টি তত্ত্ব ব্যাখ্যা করিতে পারি, স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ করার কোন প্রয়োজন নাই। সূর্য্য-চন্দ্র, গ্রহ-নক্ষত্র, নদ-নদী, পর্বত-পাহাড়, সমস্তই জড় পদার্থ; অসংখ্য পরমাণুর সম্বন্বয়ে ইহারা সংগঠিত হইয়াছে। আস্তিকরা মনে করেন এই সকল পরমাণুর সংযোগ স্থাপনের জন্য স্রষ্টার প্রয়োজন। স্রষ্টাই এসকল পরমাণু নানাভাবে সংযুক্ত করিয়া গ্রহ-উপগ্রহ সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু জড়বাদীগণ কোনো ভাবেই ইশ্বরে বিশ্বাস করেন না। তারা মনে করেন, পরমাণু গুলো আপনা আপনিই সংযুক্ত হতে পারে। তাদের সংযোগের জন্য কোনো রূপ স্রষ্টার প্রয়োজন নাই। প্রত্যেক পরমাণুর নিজ নিজ ধর্ম বা গুণ আছে; এই অন্তর্নিহিত গুণ বা ধর্মের আলোকে পরমাণু গুলো কাজ করে থাকে, অন্যের কর্তৃক পরিচালনার অপেক্ষা রাখে না। ইহাকে প্রাকৃতিক নিয়ম বলে। এইরূপ প্রাকৃতিক নিয়মের বলে পরমাণু গুলি অনন্তকাল ধরে দিকে দিকে ছুটে চলছে আবার পরস্পরের স্বভাব অনুযায়ী মিলিত হচ্ছে। আর যখন বিচ্ছিন্ন হয় তখন নিজ তেজ বা গুণের প্রভাবেই বিচ্ছিন্ন হয়। কেউ তাদেরকে মিলিত বা খন্ডিত করছে না। ইহাদের মিলন ও ভাঙ্গণ, গতি ও স্থিতি, স্পন্দন ও উত্তেজনা সবই প্রাকৃতিক নিয়মে ঘটে থাকে। এই ভাবেই জগত সৃষ্টি হয়েছে। শুধু জড় জগত নয়, আধ্যাত্মিক জগতও ঠিক এভাবেই অনুপরমাণুর ক্রিয়া প্রক্রিয়া। অর্থ্যাৎ, এই সকল অনুপরমাণু থেকে শুধু অচেতন পদার্থ নয় বরং সচেতন পদার্থেরও উদ্ভব হতে পারে। অতএব সচেতন ও অচেতন সকল পদার্থের মূলেই আছে এই সব জড় উপকরণ। তাহারা নানান ভাবে নানান উপায়ে আবির্ভূত হইয়াছে; ইহাতে কোন ইশ্বরের স্থান নাই।
জড়বাদকে অনেকেই বৈজ্ঞানিক মতবাদ বলিয়া বাহবা দিয়া থাকেন। কিন্তু ইহাকে যতই বৈজ্ঞানিক মতবাদ বলা হোক না কেন, ইহাকে কোন ভাবেই গ্রহণ করা যায় না। জড়বাদের অনেক গুলো ত্রুটি খুব সহজেই খন্ডন করা যায়। যেমন, 



প্রথমত: আমরা প্রশ্ন করতে পারি, জড় পরমাণু হতে জড় পদার্থ উৎপন্ন হতে পারে বটে, কিন্তু জড় পরমাণু হইতে অধ্যাত্ম পদার্থ উৎপন্ন হতে পারে কি? সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ ও নক্ষত্র প্রভৃতি সবই জড় পদার্থ; আর অনুপরমাণু ও জড় পদার্থ। অতএব এই সকল অণুপরমাণুর সংযোগে সূর্য চন্দ্র গ্রহ প্রভৃতি উদ্ভব হওয়া সম্ভব বলে আমরা মেনে নিলাম। কিন্তু মন ও আত্মা তো জড় পদার্থ নয়, তারা অধ্যাত্ম পদার্থ। ইহাদের সহিত জড় পদার্থের কোনো সাদৃশ্য নাই। তাহলে জড় পদার্থ হতে কিভাবে মন ও আত্মার উদ্ভব হতে পারে? জড় বস্তুর স্থান ও ব্যাপ্তি আছে; আত্মার কোন স্থান ও ব্যাপ্তি নাই। আত্মার সুখ ও দুঃখবোধ আছে, জড়ের সুখ ও দুঃখবোধ নাই; আত্মার চেতনা আছে কিন্তু জড় পদার্থের চেতনা নাই। আমরা সবাই জানি, চেতন ও অচেতন পদার্থ সম্পূর্ণ বিপরীত প্রকৃতির। জড় অনুপরমাণু থেকে জড় পদার্থ উৎপন্ন হতে পারে বটে কিন্তু কোন ভাবেই সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী মন ও আত্মার বা চেতনার উদ্ভব হতে পারেনা। সুতরাং খুব সহজেই বলা যায় মন ও আত্মা এমনি এমনি সৃষ্টি হয়নি, নিশ্চয়ই এর পিছনে বিশেষ কোনো কারিগরের হাত আছে।

দ্বিতীয়ত: জড়বাদীগণের বিশ্ব সৃষ্টির ব্যাখ্যা কোনো ভাবেই গ্রহণ করা যায় না। তারা বলেন পরমাণু অসংখ্য; অনন্তকাল ধরে এগুলো অসীম বিশ্বে ছুটে চলছে। কখনো বিচ্ছিন্ন হচ্ছে আবার কখনো মিলিত হচ্ছে, আর কখনোও বা বিস্ফোরিত হয়ে প্রলয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। তাদের ক্রিয়ার ফলেই সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র, নদ নদী ও পর্বত পাহাড় প্রভৃতি যাবতীয় পদার্থ আপনা আপনি সৃষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমরা প্রশ্ন করতে পারি, যেখানে একটা নৌকা আপনা আপনি সৃষ্টি হতে পারেনা, তখন সূর্য চন্দ্র গ্রহ নক্ষত্র এগুলো আপনা আপনি সৃষ্ট হইবে কেমন করে? ধরুন, যেসব জিনিস পত্র দিয়া নৌকা তৈরী হয়, যেমন কাঠ, কাঁটা, স্টিল, লোহা ইত্যাদি সবিই অনন্ত বিশ্বে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাহা হলেই কি তারা আপনি আপনি সংযুক্ত হয়ে সুন্দর একটি নৌকায় পরিণত হতে পারে? ইহা কি সম্ভব? নৌকার বিভিন্ন অংশের মধ্যে যে শৃঙ্খলা ও সামঞ্জস্য আছে ইহার উৎপত্তি হলো কিভাবে? এক্ষেত্রে কোথাও কোনো কারিগরের প্রয়োজন নেই কি? সবই আকস্মিক ঘটনা প্রবাহে সৃষ্টি হইতেছে ইহা কি সম্ভবপর ব্যাপার? আমরা নৌকার বিভিন্ন অংশের মধ্যে যে সামঞ্জস্য দেখতে পাই, তা অপেক্ষা হাজার কোটি গুণে অধিক অদ্ভুত শৃঙ্খলা ও সামঞ্জস্য রয়েছে সূর্য চন্দ্র গ্রহ নক্ষত্রের মধ্যে। যে আশ্চর্যরকম শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা নিয়ে এই বিশাল গ্রহ উপগ্রহ নিরন্তর আবর্তন হচ্ছে, তা ভাবলে আমরা অবাক হই। তাদের এই শৃঙ্খলা ও পারস্পরিক সামঞ্জস্য আসলো কোথা থেকে? তাইতো দার্শনিক পন্ডিতগণ বলেন যে নৌকা নির্মাণের জন্য যেমন কারিগর প্রয়োজন; এই বিশ্বজগত নির্মাণের জন্য তেমন সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজন। অর্থ্যাৎ ইহাদের কোনটিই আপনা আপনি সৃষ্টি হতে পারেনা, প্রত্যেকেরই সৃষ্টির মূলে আছে কোন এক মননশীল কর্তার মানসিক নিয়ন্ত্রণ। 

মনে করুন, আরবি আলিফ থেকে ইয়া পর্যন্ত ২৯টি হরফ আছে; বাংলা ক থেকে ঁ পর্যন্ত ৩৯টি বর্ণ আছে; ইংরেজি A থেকে Z পর্যন্ত ২৬টি অক্ষর আছে। এখন ধরুণ, আমরা যদি এই ২৯টি হরফ, ৩৯টি বর্ণ, ২৬টি অক্ষর অসংখ্য কার্ডে লিখে কার্ডগুলো অসীম আকাশে উড়াইয়া দেই এবং এগুলো অনন্তকাল ধরে আকাশে উড়ে উড়ে নানানভাবে নানান স্থানে পরস্পর সংযুক্ত হয়। তখন আলিফ,লাম,হা,মিম,দাল হরফ যুক্ত হয়ে আলহামদু শব্দ হতে পারে। এভাবে শব্দ হতে হতে বিশাল আরবি অভিধানে যত শব্দ আছে সব শব্দ হতে পারে বটে কিন্তু এই শব্দ গুচ্ছ মিলে কি বিশাল কুরআন, আরবি কাব্য, ইমরুলের উপন্যাস হতে পারে কি? ইংরেজি A, N, এবং D যুক্ত হয়ে AND হতে পারে। এভাবে ইংরেজি ডিকশনারীর সকল শব্দ সৃষ্টি হতে পারে বলে মানলাম কিন্তু তা বলে কি প্যারাডাইস লস্টের ন্যয় অর্থবহ সুচিন্তিত কাব্য রচিত হইতে পারে? বাংলা ব, ক, উ এবং ল অক্ষর যুক্ত হয়ে বকুল হতে পারে। এভাবে বাংলা অভিধানের সব শব্দ হতে পারে বলে মানলাম, তাই বলে কি মিসির আলী সিরিজ, সাইমুম সিরিজ উপন্যাস, কবিগুরু ও কবি নজরুলের সঞ্চিতা ও সঞ্চয়িতার মত বই রচিত  হতে পারে কি? মোটেই না। এতদ উপন্যাস কাব্যের প্রতিটি শব্দই সেই অভিধানে পাওয়া যাবে বটে কিন্তু তাহা হলেই কি বলবো ইহা আপনা আপনি রচিত হয়েছে? ইহার রচনার জন্য প্রয়োজন মননশীল কবির চিন্তা। তাই আমরা সহজেই বলতে পারি, পরমাণু গুলিকে অনন্ত দেশে অনন্তকালের জন্য উড়িয়া ভেড়াতে দিলেই সূর্য চন্দ্র গ্রহ নক্ষত্রে সৃষ্টি হতে পারেনা। এইসব জিনিস গুলো সৃষ্টি করিতে হইলে পরমাণুগুলিকে কোন এক পূর্ব নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুসারে পরিচালনা করা দরকার হয়। এই প্রকার পরিচালনার জন্য কোন এক মননশীল কর্তার প্রয়োজন। সেই কর্তাকে আমরা স্রষ্টা হিসেবে মানিয়া লই।

তৃতীয়ত: জড়বাদীগণ বলেন, যাহারা স্রষ্টায় বিশ্বাস করেন তাহারা স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারেনা। শুধু মাত্র ভাবাদেশে তারা স্রষ্টার অস্তিত্ব মেনে নেয়। এখানে জড়বাদীগণের বক্তব্য শতভাগ সঠিক। কিন্তু জড়বাদীগণই কি তাদের সব জিনিসের প্রমাণ দিতে সক্ষম? তারাও অনেক অনেক তত্ত্ব মেনে নিয়েছে কিন্তু প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনাই । যেমন, তারা বলে ইহকাল থেকে পরমাণু গুলো বিদ্যমাণ আছে। কিন্তু তার প্রমাণ কি?  এর প্রমাণ দেয়া সম্ভব নয় বলেই তারা এর ব্যাপারে তেমন কোনো আলোচনা উত্থাপন করেন নাই, শুধু মানিয়ে নিছেন যে অনাদিকাল থেকে পরমাণু গুলো ক্রিয়া করিতেছে। কথা হলো, পরমাণু গুলোতো অচল জড় পদার্থ; ইহারা ক্রিয়া করে কিভাবে? তাদের তো চলার গতি আসে কোথা থেকে? ইহারা কি করে একস্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হতে পারে ? অতএব শুধু পরমাণু নাই বরং পরমাণুর নিজস্ব চলৎ শক্তিও আছে। সুতরাং খুব সহজেই পরিমেয় যে, জড়বাদীগণ অনেক কিছুই মানিয়া লন। আস্তিকরা একটি মাত্র ব্যাপার মানিয়া নিয়েই জগত সৃষ্টির ব্যাখ্যা করিতে পারি কিন্তু নাস্তিকরা স্রষ্টার অস্তিত্ব না মানিয়া অনেক অনেক কিছু মেনে নিয়েও সৃষ্টি ব্যাখ্যা করতে পারেনা। 

লিখেছেন,
মুহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত ত্বোহা 
কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক; রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, ড.দিলরুবা শরমিন এন্ড অ্যাসোসিয়েটস।



Comments