ক্লাস সেভেনে থাকাকালীন ছেলেকে নিয়ে পরিবারের সদস্যদের স্বপ্ন ঘেরা একটি কবিতা পড়েছিলাম শিশু-কিশোর পত্রিকা কিশোর কণ্ঠে। যেখানে একটা লাইন ছিলো ”দাদী বলে নাতি আমার হবি জজ-ব্যারিষ্টার”। সেকাল থেকেই আইন পড়ার ইচ্ছে থাকলেও পরিবার চেয়েছিলো ইসলামিক স্কলার বানাতে। নিজ ও পরিবারের ইচ্ছের সম্বন্বয় ঘটাতে গিয়ে আমার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি কতিপয়ের দৃষ্টিতে ইবির সেরা ডিপার্টমেন্ট গুলো ছেড়ে ভর্তি হয়েছিলাম “আল-ফিকহ এন্ড লিগ্যাল স্টাডিজ” বিভাগে। ক্যাম্পাসে আমার বিশ্বস্ত অগ্রজগণ আল-ফিকহে ভর্তি হতে নিষেধ করা সত্ত্বেও বিভাগের সিলেবাস দেখে আমার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসিনি। অনেক স্বপ্ন ছিলো বিভাগকে কেন্দ্র করে। ভর্তি হওয়ার পর বিভাগের শিক্ষকদের আশা জাগানিয়া বক্তব্যে বিমোহিত হতাম। কিন্তু চারপাশে দেখতাম বিভাগের সিনিয়র ভাই-বোনেরা বিভাগের প্রতি নাখোশ। শিক্ষকদের প্রতি মনোক্ষুন্ন।সিনিয়রদের এহেন অবস্থা দেখে তাদের প্রতি আমার ছিলো বেশ বিরক্তি। কিন্তু প্রথম সেমিস্টারেই আমিও সিনিয়রদের দলে নিজেকে ভিড়াই। তার কারণ ছিলো, বিভাগের কোনো শিক্ষককে দেয়া জীবনের প্রথম ফোন আলাপটিতে শিক্ষক মহোদয়ের থেকে খারাপ আচরণ উপহার পেয়েছি বলবোনা তবে ভালো আচরণ পাইনি। খুব হতাশ হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম যিনি এখনো আমাকে তেমন চিনেন না, তিনি কিভাবে এমন রূঢ় আচরণ করেন। যাইহোক প্রথমটা খারাপ দিয়ে শুরু হলেও দিন যাচ্ছিলো বেশ। মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছিলাম জুন মাসে প্রথম সেমিস্টার পরিক্ষা দিব। কিন্তু হলের ডাল আর মেসের খিচুড়ি খেতে খেতে নভেম্বর মাস পেরিয়ে গেলেও প্রথম সেমিস্টার পরিক্ষা দিতে পারিনি। তৎকালীন বিভাগীয় সভাপতির সাথে পরিক্ষা বিষয়ে খুব পিড়াপিড়ি করে ডিসেম্বরে পরিক্ষার হলে বসলাম। আজ সপ্তম সেমিস্টারের ছাত্র আমি। আফসোস যে,গত ৬টি সেমিস্টারেই পরিক্ষা নেয়ার দাবিতে বিভাগীয় সভাপতি বরাবর আবেদন করতে হয়েছে। আলহামদুল্লিাহ ইতোমধ্যে ৭ম ও ৮ম সেমিস্টার পরিক্ষা দেয়ার দাবিতে আবেদন পত্র জমা দিয়েছি। এখন অপেক্ষার পালা শেষ হওয়ার বাকি।
বিভাগ থেকে এক্সট্রা কারিকুলাম বেজড তেমন কোনো জ্ঞান পাইনি। বিভাগে গত পাঁচ বছরে একটা কর্মশালা পাইনি। পাইনি আনুষ্ঠানিক গাইড লাইন পোগ্রাম। আউটকাম বেইজড এজুকেশন কি জিনিস তাও শিখলাম অন্য বিভাগের শিক্ষকের কাছ থেকে। বিভাগ তার বয়সের দেড় যুগ পার করেছে কিন্তু আজো একটা জার্নাল প্রকাশ হয়নি। রুটিন মাফিক প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে দুইটা পর্যন্ত ক্লাসের জন্য অপেক্ষমান থাকলেও সেমিস্টারের নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও অধিকাংশ কোর্সেরই ক্লাস শেষ হয়না। ক্লাস শিডিউলে ক্লাসের অপেক্ষমান হিসেবে ফ্যাকাল্টি ভবনের করিডোরে যে সময় দাঁড়িয়ে থেকেছি সে সময়টুকুর এক-তৃতীয়াংশ সময় পড়াশোনা করলেও আজকে নিজেকে একটা পর্যায় নিয়ে যেতে পারতাম। করোনা কালীন বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের জন্য কতকিছুই না করলেন কিন্তু আমার বিভাগে বিশেষ কিছু করাতো দূরের কথা অনলাইন ক্লাসের সময়োপযোগী ব্যবস্থাটুকুসহ ক্লাস গুলো নেয়া হয়নি। দীর্ঘ ছুটির পরেও সকল সেশনের রেজাল্ট গুলো প্রকাশ হয়নি। ২০২০ সালে অনার্স ও ২০২১ সালে মাস্টার্স শেষ করার কথা থাকলেও বিভাগের ঐতিহাসিক সেশনজট ও করোনা মহামারীর কারণে ২২ সালেও অনার্স শেষ হয়নি। হয়তো মাবুদ ইচ্ছে করলে ২০২২ সালে স্নাতক শেষ করে বিভাগ থেকে বের হয়ে যাবো।
কিন্তু কথা হলো বিভাগের এই পথচলায় আমি কি পেলাম?  আমরা কি পেলাম?  এই প্রশ্ন দুটোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ি।  অসাড় হয়ে ভাবি বিভাগ কি আসলেই আমাদের কিছু দেয়নি।আলহামদুলিল্লাহ।  প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পথ কন্টকাকীর্ণ হলেও উত্তরটা অমীয় স্বাদের। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন অধিভুক্ত প্রায় ১৬৩টি সরকারি,বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।  সে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে যে দুয়েকটা মডেল বিভাগ আছে তন্মধ্যে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদভুক্ত “আল-ফিকহ এন্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগ”অন্যতম।  শরীয়াহ আইন ও প্রচলিত আইন বিষয়ে গবেষণা ও জ্ঞানের প্রসারের লক্ষ্যে এই বিভাগ অগ্রগণ্য।  বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি এই বিভাগের ছাত্র এটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া।  পাশাপাশি জ্ঞানে গুণে গুণান্বিত বিভিন্ন ধারার প্রতিভার অধিকারী আটজন শিক্ষক পাওয়া আমার সমগ্র জীবনের অন্যতম পাওয়া।  বিভাগের এমন কয়েকজন শিক্ষক পেয়েছি যাদের ছাত্র হওয়ার নূন্যতম যোগ্যতা আমার নাই।  স্যারদের থেকে নিয়মিত সিঁকি সিঁকি পরিমাণ করে শিখি।  শিক্ষকদের স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য ও পাঠদানে আমি মুগ্ধ।  কয়েক শিক্ষকের সান্নিধ্য আমার স্পৃহাকে শত গুণে বাড়িয়ে দেয়।  তাদের নসীহা গুলো আমার পথ চলার পাথেয়।  সেশনজট শিক্ষার্থীর ক্যারিয়ার হত্যার শামিল হলেও মাঝে মাঝে দুয়েকজন শিক্ষকের সান্নিধ্যের জন্য হলেও ক্যাম্পাসে আরো কিছুদিন থাকতে মন চায়।   বিভাগে আজ ছয় বছর চলমান থাকলেও কখনো শিক্ষকদের স্বকীয় কর্মতৎপরতায় আমি হতাশ নই।  কিন্তু তবুও অদৃশ্য কোন কারণে আমাদের বিভাগের এই নাজেহাল অবস্থা তা দৃষ্টিগোছর না হলেও বুঝতে বাকি থাকেনা।  তবে আমি আশানিয়া একদিন আমার বিভাগ সকল জড়তা ঝেড়ে সমস্যা কাটিয়ে তার আপন স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে ঘুরে দাঁড়াবে।  মাথা উঁচু করে বিশ্ব-ভুবনে নিজের পরিচয় তুলে ধরবে।  দেশের আইন জগতে নেতৃত্বে বড় ভূমিকা রাখবে।  যে সম্ভাবনা ইতোমধ্যে বিভাগের অগ্রজদের কর্ম-সফলতায় ফুটে উঠছে।  আমরা নির্দ্বিধায় বলে থাকি বিভাগ আমাকে কি দিলো? স্যাররা আমাদের জন্য কি করলো?  আসলে কেউ কাউকে কিছু দিতে পারেনা।  শিক্ষকদের কাজ হলো কিছু সৎ মানুষ তৈরী করা,যা আমাদের শিক্ষকরা করে যাচ্ছেন। আমাদের শিক্ষার্থীদের নিয়েই আমাদের বিভাগ।  বিভাগের শিক্ষকদের সফলতায় বিভাগের সফলতা নির্ভর করেনা বরং শিক্ষার্থীদের অর্জনই বিভাগের অর্জন।  আমি নিজে সফল হলে আমার বিভাগ সফল আর আমি ব্যর্থ হলে বিভাগ ব্যর্থ।  তাই নিজেকেই পোঁড়াতে হবে নিজেকেই ঘুরে দাঁড়াতে হবে।  আমরা হতাশ নই,আমরা উদ্যমী।  আমরা ডান-বাম দু’দিক থেকেই লিখতে শিখেছি। আমি বিশ্বাস করি, শিক্ষকগণের প্রচেষ্টায় সেশনজট কাটিয়ে তাদের সৌহার্দপূর্ণ নিবিড় তত্ত্বাবধানে আমার প্রিয় বিভাগ লক্ষ্য পানে এগিয়ে যাবে।
ইনশাআল্লাহ।
ত্বোহা
১৬-১৭ সেশন।
আল-ফিকহ এন্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
রচনাকাল-১৪ই জানুয়ারী ২০২২
 
Comments