কুরবানির বিধান ও বর্তমান মুসলিম সমাজের দ্বৈরথ!

 কুরবানী! ইহা ধনবান মুসলিম ব্যক্তির উপর আবশ্যক বিধান। যাহা মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম আলাইহিসসালাম হতে প্রচলন ঘটে।ইসলামের বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী, মহান আল্লাহ তা’আলা ইসলামের রাসুল হযরত ইব্রাহীম (আঃ)কে স্বপ্নযোগে নির্দেশ দেনঃ “তুমি তোমার প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে কোরবানি কর”। ইব্রাহীম (আঃ) স্বপ্নে এ আদেশ পেয়ে ১০টি উট কোরবানি করলেন। পুনরায় তিনি একই স্বপ্ন দেখলেন। ইব্রাহীম (আঃ) আবার ১০০টি উট কোরবানি করেন। এরপরেও তিনি একই স্বপ্ন দেখে ভাবলেন, আমার কাছে তো এ মুহূর্তে প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.) ছাড়া আর কোনো প্রিয় বস্তু নেই। তখন তিনি পুত্রকে কোরবানির উদ্দেশ্যে আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। যখন ইব্রাহীম (আঃ) আরাফাত পর্বতের উপর তাঁর পুত্রকে কোরবানি দেয়ার জন্য গলদেশে ছুরি চালানোর চেষ্টা করেন, তখন তিনি বিস্মিত হয়ে দেখেন যে তাঁর পুত্রের পরিবর্তে একটি প্রাণী কোরবানি হয়েছে এবং তাঁর পুত্রের কোন ক্ষতি হয়নি। এই ঘটনাকে স্মরণ করে সারা বিশ্বের মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রতি বছর এই দিবসটি ঈদ উল আধহা নামে উদযাপন করে।

হযরত ইব্রাহিম আলাইহিসসালামের সুন্নত হিসেবে উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য হিজরী ক্যালেন্ডারের ১২ তম চন্দ্র মাসের জিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১৩ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত কুরবানী করার সময় হিসেবে নির্ধারিত। । এ দিনে বিশ্ব জুড়ে মুসলমানরা কুরবানী দেয় যার অর্থ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার খুুুশীর জন্য নির্দিষ্ট দিনে একটি পশুকে জবেহ করা। ইহা পুত্রের পরিবর্তে ইব্রাহিমের একটি মেষের আত্মত্যাগের পুনরাবৃত্তি, যা ইহুদীধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা এবং ইসলাম বিশ্বাস করে ঘটনাটিকে।
কুরবানির হুকুমঃ
কুরবানির হুকুম নিয়ে ইমামদের মতবিরোধ রয়েছে।
১.ইমাম আবু হানিফা,মালেক,যুফারের মতে_যে ব্যক্তি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক তার উপর কুরবানী ওয়াজিব।
দলীল:নবী (স.) এর বাণী,"যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করে না,সে যেন আমার ঈদগাহে উপস্থিত না হয়"।
২.ইমাম শাফেয়ীর মতে_কুরবানী করা সুন্নাত।
৩.ইমাম মুহাম্মদের মতে_কুরবানী করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ।
বি:দ্র-ইমাম হানিফার মতটিই অতি গ্রহণযোগ্য
কুরবানির গোশতের হুকুম:
১.কুরবানির গোশত কুরবানিদাতা নিজে ভক্ষণ করবে এবং অন্যদেরকেও ভক্ষণ করাতে পারবেন।
২.ইচ্ছানুযায়ী আত্মীয়, প্রতিবেশী,ধনী,গরীব, মুসলিম, অমুসলিম সকলের মাঝে বিলিয়ে দিতে পারবে।
৩.ইচ্ছা করলে সব গোশতই সদকা করে দিতে পারবে তবে একতৃতীয়াংশ গরিবদের মাঝে সদকা করা মুস্তাহাব।
৪.পরিবারের সদস্য বেশি হলে নিজের পরিতৃপ্তির জন্য সব গোশতই ভক্ষণ করতে পারবে,তবে এটি কুরবানির জন্য বেমানান।
৫.কুরবানির গোশত বিক্রি করা বা তাদ্বারা জবাইয়ের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের মজুরী দেয়া বৈধ নয়।
৬.কুরবানির গোশত সংরক্ষণ করা বৈধ।
৭.কুরবানির গোশত বন্টনে অংশীদারদের মাঝে সমতা রক্ষা করতে হবে।
কুরবানির চামড়ার হুকুমঃ
১.চামড়া (নিজে /অংশীদারদের সম্মতিতে) সদকা করে দিতে পারবে।
২.চামড়া দ্বারা ব্যবহার্য দ্রব্য তৈরী করে নিজে ব্যবহার করতে পারবে।
৩.চামড়ার বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ করলে তা গরীবদের মাঝে বন্টন করে দিতে হবে।এই অর্থ নিজে খরচ করা হারাম।
৪.পারিশ্রমিক হিসেবে চামড়া বা চামড়ার মূল্যের টাকা প্রদান করা যাবেনা।
♥কুরবানির বৈধ পশু ও এর বয়সের বিধান:
১.উটঃউটের বয়স কমপক্ষে ৫ বছর হতে হবে।
২.গরু/মহিষঃএদের বয়স কমপক্ষে ২ বছর হতে হবে।
৩.ছাগল/ভেড়া/দুম্বাঃএদের বয়স কমপক্ষে ১ বছর হওয়া উত্তম। তবে ৬ মাসের মোটাতাজা বাচ্চাকে যদি ১ বছরের বাচ্চার মত দেখায়,তাহলে তা দ্বারা কুরবানি বৈধ হবে।
যেসব পশু দ্বারা কুরবানী বৈধ নয়ঃ
১.পশুর এক/উভয় চোখ অন্ধ হওয়া।
২.লেংড়া পশু,যা কুরবানির স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারেনা।
৩.দাঁতহীন পশু
৪.জন্মগত ভাবে কানহীন পশু।
৫.স্তনের মাথা কাটা পশু।
৬.ময়লা,আবর্জনা ও পায়খানা খেতে অভ্যস্ত পশু।
৭.যে পশুর পা কাটা।
৮.লেজের অধিকাংশ কাটা থাকা।
৯.পশু প্রাপ্ত বয়স্ক না হওয়া।
♥আত্মসাৎকৃত প্রাণী দ্বারা কুরবানির বিধানঃ
আত্মসাৎকৃত প্রাণী দ্বারা কুরবানি বৈধ।কেননা__
কুরবানির পূর্বশর্ত হলো পশুর মালিক হওয়া।যেহেতু আত্মসাৎ করার সময় হতেই উক্ত প্রাণীর মধ্যে ক্ষতিপূরণ সাপেক্ষে আত্মসাৎকারীর মালিকানা সাব্যস্ত হয় সেহেতু তাদ্বারা কুরবানি বৈধ।
অতএব ছিনতাই তথা অবৈধ মালিকানার কারণে সে ভিন্ন ভাবে হাক্কুল ইবাদ নষ্ট করার জন্য গুনাহগার হবে।
তবে বাহ্যিক ফতুয়া মতে,কুরবানী তাৎক্ষণিক শুদ্ধ হলেও আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে কুরবানির প্রকৃত উদ্দেশ্য অর্জন সম্ভব হবে না।
কুরবানি কবুল হওয়া ও এর ফজিলত লাভের সহজ উপায় :
কুরবানি কবুল হওয়া এবং এর যথাযথ ফজিলত লাভের জন্য কিছু কিছু বিষয়ে অত্যন্ত সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে।আর কিছু বিষয় পরিহার করতে হবে। যে সকল বিষয়ে অতি মাত্রায় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে তা হচ্ছে কুরবানী হবে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি রেজামন্দি হাসিলের উদ্দেশ্যে, হালাল ও বৈধ অর্থের মাধ্যমে। আর এগুলো সকল ইবাদত কবুলের ও শর্ত। কুরবানী হতে হবে মনের ঐকান্তিক আগ্রহসহকারে শুধুমাত্র আল্লাহর আদেশ পালন, ইব্রাহীম নবীর সুন্নতের অনুসরণ অনুকরণের বাস্তব নমুনা হিসাবে ইসলামী শরীয়ার একটি বিধান পালনের নিমিত্তে। এ দুটি বিষয়ের অনুপস্থিতিতে অথবা দুটির একটির অনুপস্থিতিতে কুরবানী বা অন্য যে কোন নেক কাজ ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না বরং লোক দেখানো যে কোন ইবাদত শিরক,যা আল্লাহ মাফ করবেন না বলে ঘোষণা করেছেন সুরা মায়িদার ৭১ নাম্বার আয়াতে।
(১) নিয়তের বিশুদ্ধতা: ইহা যে কোন ভাল কাজ ইবাদত বন্দেগী ও কুরবানী কবুলের প্রথম এবং পূর্ব শর্ত। কিন্তু বর্তমান মুসলিম সমাজের বিশাল একটা অংশ সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করে থাকে কেবল গোসত খাওয়ার জন্য বা সমাজে তার অবস্থান ধরে রাখার জন্য।আবার কিছু লোক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করেনা।যা মোটেও কাম্য নয়।
(২) অর্থের বিশুদ্ধতা: অবৈধ অর্থের দান সদকা হজ্জ মসজিদ মাদ্রাসা নির্মাণ,কুরবানী ইত্যাদি কোন বিষয়ই কবুল হয় না। কিন্তু বর্তমানে সমাজে বহু আমলা ও মাতব্বর রয়েছে যাদের মাসিক বেতন ৪০/৬০ হাজার টাকা কিন্তু তারা লক্ষ লক্ষ টাকার পশু কুরবানি করছে।যা নিঃসন্দেহে ঘুষ বা এজাতীয় অবৈধ পন্থায় রোজগারকৃত টাকা।
(৩) শরিক নির্বাচনে সতর্কতা:যেহেতু কুরবানী আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য তাই সকলের ইখলাছ এক রকম হয় না। তাই শরীকদের কোন এক জনের নিয়তে অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকলে বাকী সকলের কুরবানী বাতিল। কুরবানিতে শরীক নির্বাচনের ক্ষেত্রে সুদ খোর ঘুষ খোর, বেনামাজি, প্রতারক অবৈধ পণ্যের ব্যবসায়ীর সাথে কুরবানী করা উচিৎ নয়
(৪)বাজার হতে পশু ক্রয় করে বাজারের ট্যাক্স দিতে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করা: এ কাজটি করা মোটেই ঠিক নয় কিন্তু অনেকে নানা কলা কৌশলে ট্যাক্স ফাকিঁ দিতে চায়, কেহ কেহ ফাঁকি দেয়। ইহা অনুচিত, কারণ কুরবানি একটি ইবাদত
(৫)শুধু পরিবারের প্রধানের নামে কুরবানী দেওয়া নয় বরং যদি কোন পরিবারে একাধিক সদস্য থাকে সবাই আয় রোজগার করে এবং সবার উপর কুরবানী ওয়াজিব হয় সেই ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই কুরবানী দেবে যদিও যৌথ পরিবার
(৬) কুরবানীর গোশত বিক্রি করে দেওয়া যায় না বরং দান করা যায়
(৭) কুরবানীর গোশত শরিকদের মাঝে পাল্লা দিয়ে ওজন করে বন্টন করতে হবে।
(৮). জবেহকারী বা কসাইকে গোশত বানানোর মজুরী স্বরূপ গোশত, চামড়া, রশি ইত্যাদি দিয়ে দেওয়া যাবে না
(৯) রাসুল সা: এর নামে কুররবানী দেওয়া নয় বরং আল্লাহর নামে দিতে হবে
(১০)পশুর অপ্রয়োজনীয় অংশ গর্ত করে মাটির নিচে পুতে ফেলতে হবে নতুবা অপ্রয়োজনীয় অংশ হতে দুর্গন্ধ ছড়াবে, যা পরিবেশ দূষণ করে রোগ-ব্যাধি ছড়ায়।
(১১)বড় পশু ক্রয়ের প্রতিযোগিতা করা উচিত নয় বরং মনের পশুকে দূরীকরণের প্রতিযোগিতা করা উচিত।
(১২)পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন এমনকি অমুসলিমদের মাঝে ও কুরবানীর গোশত বিতরণ করা যাবে।
(১৩)মান্নতের কুরবানী দেওয়া যাবে তবে কোন কুরবানী-ই কোন ব্যক্তির নামে নয় বরং সকল কুরবানী-ই হবে আল্লাহর নামে।
সবিশেষ
কুরবানীর পশুর রক্ত মাংশ এর আকার আকৃতি ইত্যাদি আল্লাহ তায়ালার কোনই প্রয়োজন নেই বরং এর সবকিছুই আমাদের জন্য। আমাদের কোন না কোন উপকারার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। যখন কোন চাকুরীজীবী, ব্যবসায়ী, প্রবাসী অথবা অন্য কোন পেশায় নিয়োজিত নারী পুরুষ কোন পশু কুরবানী করতে চায় কিন্তু তার পশু নেই। সে বাজার হতে যখন পশু ক্রয় করে তখন পরোক্ষভাবে সমাজের অপরাপর পেশায় নিয়োজিত সকলের প্রতি তার অবদান শুরু হয়ে যায়। যা ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রের অগণিত কল্যাণ বয়ে আনে। শুধু কুরবানীতেই হালাল পশু জবাই হয়না বরং দৈনন্দিন জীবনে মানুষের জীবন ধারনের এক অসীম প্রয়োজনীয় বস্তু হচ্ছে পশু পাখী জীব জন্তু। যার কোন না কোন অংশ আমাদের উপকারে আসছে। উন্নত মানের জুতা, মানি ব্যাগ, বেল্ট তৈরীতে পশুর চামড়াই প্রধান উপাদান। মিষ্টি জাতীয় খাবার তৈরীতে দুধের বিকল্প নাই। আমাদের শরীরে পুষ্টি যোগাতে, বিয়ে-শাদী, শিশুদের আকীকা, সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে হালাল পশুর গোশতের বিকল্প আর কিছুই নাই। তাহলে অতি সহজেই বুঝা গেল যে শুধু কুরবানীতেই পশু জবাই নয় বরং প্রতি নিয়তই মানুষের কল্যানে পশু জবাই আল্লাহ বৈধ করেছেন।
অপচয় অপব্যয় ব্যতীত যদি বৈধ পথে মানবতার কল্যাণে পশু জবাই করা হয় কুরবানী দেয়া হয় তা হলে নি:সন্দেহে তা ছওয়াবের কাজ,পূণ্যের কাজ মানবতা মনুষত্বের কাজ,সমাজ সেবা মূলক কাজ। যদি কেহ সামর্থ রাখে তাহলে ভাল কাজ প্রতি মুহূর্তে করলেই সমস্যা কোথায়? যদি কুরবানী মানুষের ক্ষতির কারণ হতো তাহলে আল্লাহ এ বিধান দিতেন না। বর্তমান মুসলিম সমাজের যারা কুরবানীতে পশু নিধনের দোহাই দিয়ে জাতীয় আয়ের জন্য মায়া কান্না করে, তারা নিজেরাই জাতীয় দায়! এ দেশের বোঝা! দেশ জাতি এবং মুসলিম উম্মাহর শত্রু। তারা মূলত মহান আল্লাহর বিধান কে উপেক্ষা করতে চায়! তারা মুসলমান নামের কলঙ্খ! নকল মুসলমান! মুসলমান উম্মাহর ফোঁড়া! তাদের কে সামাজিক ভাবে বয়কট করা দরকার । সরকারের উচিৎ যারা এ জাতীয় বিভ্রান্তিমূলক কথা বলে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায় তাদের কে প্রচলিত আইনের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তির সম্মুখীন করা!
[তথ্যসূত্র-বিদয়াতে মুজতাহিদ,শরহে বেকায়া,নেহায়াসহ ততোধিক ফিকহী গ্রন্থ।]
লেখক,
মুহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত ত্বোহা
প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার এক্টিভিস্ট
সদস্য,এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
শিক্ষার্থী
আল-ফিকহ ও আইন অধ্যয়ন বিভাগ
ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
ইমেইল- tohaarafat1998@gmail.com
মোবাইল-01781704368

Comments