পরিণয়


                                                

সিংকের উপর ঝুকে আলিসা দুপুরের এঁটো বাসনগুলো মাজছিলো । আবির সোফায় বসে টিভি দেখতে দেখতে আলিসাকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমার রূপ-গুণ কিছুই আমাকে আর টানেনা কেন আলিসা? শুধু রূপ-গুণের কথা বলছি কেন অভ্যাসগত কারণেও তোমার শরীরটাও আমাকে আর টানেনা। বিরক্ত লাগে অনেক।

আলিসা পানির কল ছেড়ে দিয়ে এঁটো থালাগুলো চুপচাপ ধুয়ে যাচ্ছিল। আবিরের কথাগুলো তার কাছে আকস্মিক নয় তাই সে হতবাকও নয়, আবার এই কথাগুলো নতুনই নয়। তাই সে নীরবে ঝড়ঝাপটা বুকে টেনে নিয়ে এঁটো থালাগুলো মেজেই চলছে। আলিসার ঠোঁট জোড়া চুপ থাকলেও চোখজোড়া সরব। চোখের জল গড়িয়ে কলের জলের সাথে মিশে তলিয়ে যাচ্ছে নিচের দিকে।

ঝাপসা চোখে আলিসার চোখে অতীতের স্মৃতি ভেসে ওঠে। আবির তখন ইউনিভার্সিটির ফোর্থ ইয়ারের ছাত্র। আলিসা সদ্য জুনিয়র। ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে আলগোছে সুন্দরী মেয়েটাও আলিসা। অনেকে প্রপোজ করে কিন্তু আলিসা পাত্তা দেই না। আলিসা আবিরকেও সেভাবে রিজেক্ট করে দিয়েছিলো। কিন্তু আবির তার পিছু ছাড়েনি। ঘুরঘুর করতে করতে একসময় ওকে পাগল করে তুলেছিল প্রেমটা করার জন্য। তারপর দুজন একমাস প্রেম করেছিলো। একদিন আবিরের নাকের গরম নিশ্বাস আলিসার কানে উষ্ণতা ছড়াতে সে বলেছিল, এতো তাড়া কিসের? যা হবে সব বিয়ের পরেই হবে।

পরদিন আবির বেশ অবাক করে দিয়ে তার বাবা-মাকে নিয়ে হাজির হয়েছিলো আলিসাদের বাসায়। সারপ্রাইজটা পেয়ে আবেগে আলিসার জল গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। শান্ত, গভীর ছেলেটার চোখে সেদিন সে খুঁজে পেয়েছিল আদিম এক বিশ্বাস। যে বিশ্বাসের আস্তানায় ভর করে কাটিয়ে দেওয়া যায় আস্ত একটা জীবন।

আলিসার দম বন্ধ হয়ে আসছিল কান্নাচাপা সুরে। আবিরের ডাকে স্তম্ভিত ফিরে আলিসার। বলে,

কি হলো! কিছু বললেনা যে? প্রশ্নের উত্তরতো দিবা। 

" কি হল! কিছু বললে নাতো!",প্রশ্নটা তৃতীয়বারের মতো করে আবির তাকিয়ে থাকল তার দিকে।

"হুম কি বলবো বলো!", আলিসা কোনোরকমে বলল।

সাবান দিয়ে কড়াই এর দাগ তুলতে তুলতে তার অদ্ভুত একটা কথা মনে হল, এই বাসনকোসন গুলো দিনের পর দিন এঁটো হয়, এগুলোতে দাগ লাগে, কিন্তু একটু ঘষামাজা করলেই কেমন যেন আবার নতুনের মতো হয়ে যায়।মানুষের জীবনটাও যদি এরকম হতো! ঘষামাজা করে যদি জীবনের দাগ গুলোও মুছে ফেলা যেতো! আবার নতুন করে যদি তুলে ধরা যেতো জীবনকেও। কি ভালোই না হতো। ঘষামাজার চেষ্টা যে সে করেনি এমনটা নয়। ইউটিউব দেখে নতুন নতুন রান্না শিখে আবিরকে খাইয়েছে। সাদের জন্মের পর শরীরটা একটু ভারী হয়ে উঠেছিল। মেদ জমে উঠেছিল কোণায় কোণায়। আলিসা যোগ ব্যায়াম এর ক্লাসে জয়েন করে। দীর্ঘ কয়েক মাসের পরিশ্রমের পর শরীরটাকেও অনেকটা আগের মতো করে তোলে। সংসার সামলে, ছোট্ট সাদের সারাদিনের ঝামেলা মিটিয়েও সে আবিরের জন্য নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করেছে। বিশেষ লাভ হয়নি। ওই সাপ্তাহিক জৈবিক চাহিদা মেটানো বাদ দিয়ে আবির খুব একটা তার কাছে আসেনি। আসেওনা। কাজের ব্যস্ততা না থাকলেও আবির খুব একটা সময় দেয়না তাকে।তাদের মধ্যেকার কথাবার্তা গুলোও কেমন যেন নিয়মমাফিক পানসে হয়ে গেছে। সেগুলো বিভিন্ন কাজের অনুরোধ বা নির্দেশিকা।

" 'কি বলবো বলো'টা আবার কি কথা হল? আমি তো একটা সিরিয়াস কথা বলছি। ওদিকে ঘুরে আছো কেন?", আবির বিরক্তি প্রকাশ করলো।

আলিসা ঘুরে হাসার চেষ্টা করল। চোখ বাঁধ মানলোনা। গালটা অববাহিকার মতো নদীর গতিপথের সাক্ষী। মেঘলা চোখে, ঠোঁটে জোর করে হাসিটাকে ধরে রাখার চেষ্টা করেই উত্তর দিল,

--আমি তো চেষ্টা করেছিলাম আবির। পারিনি।"

"তোমাদের মেয়েদের এই এক ন্যাকামো। কিছু বলতে না বলতেই কান্নাকাটি শুরু। অসহ্য।", একমুখ বিরক্তি নিয়ে আবির উঠে গেলো বারান্দায়।

আলিসা হেসে ফেলল। এই হাসির মধ্যেও অদ্ভুত এক যন্ত্রণা মিশে আছে। স্মৃতিপট থেকেই সেইদিনটা আবার ভেসে উঠলো তার সামনে। আবিরকে কাছে পাওয়ার আবেগে,নিজের মধ্যে মিশিয়ে নেওয়ার আনন্দে সেদিনও যখন তার চোখে জল এসেছিল। উদ্বিগ্ন পুরুষ কন্ঠে সেদিন প্রশ্ন এসেছিল," একি কাঁদছো কেন!" আলিসা হাত দিয়ে সুখের সেই চিহ্নকে চোখের কোণ থেকে মুছতে মুছতে জানিয়েছিল,"এমনি কেন কে জানে! হয়ত তোমাকে পাওয়ার আনন্দে।" ফোর্থ ইয়ারের সেই ছেলেটা হেসে প্রতিবাদ করেছিল,"পাগলি একটা!"

"অসহ্য", কথাটা বারবার প্রতিধ্বনিত হয়ে আলিসার কাছে ফিরতে লাগলো। সত্যিই কি সে অসহ্য হয়ে গেছে

কয়েকবছর একসঙ্গে থাকার পর কি সব প্রেম- এরকম অসহায় হয়ে পড়ে! সব প্রেমিকাই কি অসহ্য হয়ে ওঠে!

উঁহু। ব্যতিক্রম তো আছেই। তার বাবা মা- জলজ্যান্ত উদাহরণ। দীর্ঘ সাতাশ বছর তাদের বিবাহিত জীবন পেরিয়ে এসেছে, অথচ এখনও কি সুন্দর বন্ডিং।বাড়ি গেলে এখনও সে মা বাবার মধ্যে দুষ্টু মিষ্টি প্রেম গুলো দেখতে পায়। সব প্রেম ভালোবাসায় পরিণত হতে পারেনা।এই যেমন তাদেরটা হয়নি।সে যাকে তার জীবনের শেষতম সত্যি ভেবে নিয়েছিল, তার কাছে সে দুর্নিবার আকর্ষণ ছাড়া কিছু ছিলোইনা।ভালোবাসা চিরস্থায়ী। কিন্তু আকর্ষণের মৃত্যু আছে।আকর্ষণের মেয়াদ খুবই কম।একদিন হঠাৎ করেই ফুরিয়ে যায়।

কিন্তু একজন তফাত করবে কি করে! দূর থেকে তো সব আকর্ষণকেই ভালোবাসা মনে হয়।সব " কাছে এসো"কে "পাশে থাকবো" মনে হয়।হয়ত অপেক্ষা সেগুলোকে আলাদা করে দেয়।সেই নিরু বলে ছেলেটা, যে তার আর আবিরের সম্পর্ক আছে শোনার পরও জানিয়ে ছিলো,"বেশ,তুমি যাও।কিন্তু কোনোদিনও যদি মত পরিবর্তন করে আসতে চাও,জানিও।" সেও তো দীর্ঘদিন ধরে ওকে ভালোবাসতো।পাত্তা দেইনি সে। অসহায় ভাবে ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করতে পারেনি।নিরু আবিরের মতো এতো পিছু পিছু ঘুরঘুর করেনি।রোজ দূর থেকে দেখতো আলিসা কে।কেউ তার দিকে খারাপ দৃষ্টি দিলে অসহ্য হয়ে তাদেরমক দিতো।প্রথমে বুঝতেই দেইনি সে তাঁকে ভালোবাসে।বন্ধুর মতো আগলে রেখেছিলো তাকে।তারপর যেদিন বলল আলিসার অনুমতি পায়নি বলে দূরে সরে গিয়েছিল কিছু কথা বলে।

তবে আবিরের ধৈর্য বরাবরই কম। সদ্য ব্রেক-আপ থেকে ওঠার দুমাসের মধ্যেই সে আলিসাকে প্রেম নিবেদন করেছিলো।সেই ফোর্থ ইয়ারের মাঝামাঝির ঘটনা।আলিসার মনে হয়েছিল একটা ভেঙে যাওয়া মানুষ বোধহয় অবলম্বন ছাড়া বেশিদিন বাঁচতে পারেনা।আবিরের প্রতি তার সুপ্ত দুর্বলতা থেকে সেদিনই সে রাজী হয়ে গিয়েছিল সেই অবলম্বন হওয়ার জন্য।তারপর প্রেম হয়ে উঠতে না উঠতে আবির তাকে বুঝিয়েছিল,ভালোবাসার থেকে শরীর কে আলাদা করে রাখার কোনো মানেই হয়না।দুটোই একে অপরের সাথে সম্পর্ক যুক্ত।কিছু সামাজিক প্রতিবন্ধকতা পূর্ণ মানুষ শরীরটাকে সূচি অসূচির জায়গায় নিয়ে গেছে।আলিসা বিশ্বাস করে নিয়েছিল সেই কথাগুলো।বহুবার নিঃসংকোচে মিলনের জোয়ারে নিজেকে মেলে ধরেছিল তারপর।বর্তমানের পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে তার মনে হচ্ছে এগুলোর মধ্যে ভালোবাসা কোথায় ছিল!পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটা,একসাথে বসে আড্ডা দেওয়া,অবিরত মিলনের রাত একসাথে কাটানো.. এগুলো তো আকর্ষণের মতোই দেখতে,এতে ভালোবাসার রূপ কোথায়?

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এককাপ গরম চা নিয়ে আলিসা আবিরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।কয়েকমুহূর্ত সময় নিয়ে আলিসা জিজ্ঞেস করলো,"আর কি দিতে পারি বলো!"

চায়ের কাপটা নিজের হাতে নিতে নিতে ব্যঙ্গের সুরে আবির জবাব দিলো,

--দেওয়ার আর কিছু আছে তোমার! তোমার বুকের বাঁদিকের তিলটা অবধি মুখস্থ আমার। তুমি কোন কথার উত্তরে কি বলবে সেটা পর্যন্ত আমি বলে দিতে পারি।তুমি নতুন কি করবে আমার জন্য!"

"তুমিই বলো,কি করলে তোমার আমাকে নতুন মনে হবে!", আলিসা হাসার চেষ্টা করল।

" জানিনা সেটা।আমার মনে হয় আমাদের সম্পর্কের মধ্যে আর তেমন কিছু বেঁচে নেই।তোমাকে আমার জানার কিছু নেই।আমি ওই সারাজীবন চুপচাপ এটাকে মেনে নেওয়ার থেকে এখনই জানিয়ে দিলাম।যাতে পরে তোমার কষ্ট নাহয়।",আবির কথগুলো বলে চায়ের কাপে চুমুক দিলো।

"তোমাদের উপুড় করে না ঢাললেও তোমরা সন্দেহ করো,তোমাদের সব উপুড় করে ঢেলে দিলেও তোমরা বিরক্ত হও।কোথায় যাবো আমরা!", আলিসা আনমনে কথাগুলো বলে গেলো!

" তোমাদের!",আবির থামল।

"কজনের সাথে সংসার করেছো শুনি!"

আলিসা উত্তর দিলো না।ওর শুধু মনে পড়ছে সেই অধৈর্য ছেলেটার কথা যে ফার্স্ট ইয়ারে পড়তে পাগল করে দিয়েছিল তাকে তার অতীত সম্বন্ধে বলার জন্য!যতবার সে "কিছুই নেই তেমন বলার মতো" বলে এড়িয়ে গেছে, ছেলেটা মুখ শুকনো করে বলেছে,"নিশ্চয় কিছু আছে।না থাকলে চুপ করে থাকতেনা।" আলিসার তখন সেগুলোকে নিরপরাধ প্রেমিকের অভিমান মনে হয়েছিলো।

আবির আবার শুরু করলো,"দেখো আমি সোজাসাপ্টা কথা বলতে পছন্দ করি।তাই তোমাকে আগে থাকতেই বলে দিলাম।তুমি যদি ডিভোর্স চাও,আমি দিয়ে দিতে পারি।কারন এরকম একটা মানুষের সাথে তোমারও থাকার মানে হয়না।এবার তুমি ভেবে দেখো।কি করবে!"

"ডিভোর্স ",শব্দটা শুনে দু পা পিছিয়ে এলো আলিসা। উদ্বিগ্ন মুখে প্রশ্ন করলো," সাদের কি হবে!" চা শেষ করে কাপ টা পাশে নামিয়ে রাখতে রাখতে স্বাভাবিক গলাতেই আবির উত্তর দিলো,

--"ডিভোর্সের পর তুমি বললে ওকে আমার কাছে রাখতে পারি,আর তুমি চাইলে তুমিও রাখতে পারো।তবে মায়ের কাছে থাকাটাই ওর জন্য ভালো হবে।তুমি যদি অন্যকাউকে বিয়ে করে নাও তাহলে নতুন বাবাও পেয়ে যাবে।"

"তুমি যদি অন্য কাউকে বিয়ে করে নাও", কথাটা তিরের মতো এসে আলিসার বুকে বিঁধলো।এই সেই মানুষ যে একদিন তাকে জড়িয়ে সোহাগে বলেছিলো,

--" আমাকে ছেড়ে কোথাও যেওনা প্লীজ।আমার কাছেই সারাজীবন থেকো।"

আলিসা আর কিছু ভাবতে পারলোনা।সে শুধু শেষ আর একটা প্রশ্ন করলো,"তুমি কি কাউকে দেখে রেখেছো! যার সাথে তুমি এরপরে থাকবে!" আবির কিছুক্ষণ নীরব সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলো,তারপর উত্তর দিলো,"হ্যাঁ আছে একজন।আমাদের অফিসেই কাজ করে।সেভাবে এগোইনি।তবে মেয়েটার মধ্যে অদ্ভুত এক চমক আছে।ভেবেছি যদি বেরিয়ে আবার কারোর সাথে থাকি তাহলে ওর সাথেই থাকবো হয়তো।এখনও ঠিক নেই কিছু।

আলিসা শুধু, "আচ্ছা" বলে বেরিয়ে এলো।

সারা সন্ধ্যে সে নিজের ঘরে লাইট অফ রেখে কাঁদলো।জল টানতে টানতে যখন বালিশটাও ক্লান্ত হয়ে উঠলো, ফোনটা হাতে নিয়ে কল করলো সে।নিরুর নাম্বারটা কি একটা কারণে সে রেখে দিয়েছিল নিজের কাছেই।জীবনে ঘুরিয়ে কল করেনি।তাও রেখে দিয়েছিল।কলটা কানেক্ট হতেই কলারটিউনে ভেসে এলো,"তুমি রবে নীরবে...হৃদয়ে মম... " গানটা বন্ধ হতেই ওপার থেকে একটা পুরুষ কন্ঠ বলে উঠল, " বল।"

আলিসা ধরাধরা গলায় বলল,"তুই জানিস আমি কে?"

ওপারের পুরুষ কন্ঠটি হেসে উঠল,"নাম্বারটা বহুযুগ ধরেই সেভ করা ছিল।তোর কলের অপেক্ষা করেই ছিলাম।"

আলিসার গলা বুজে এলো।"অপেক্ষা" এই শব্দটা বৃষ্টির মতো ওর অন্তরস্থলে এসে পড়লো। 

কোনোকিছুর প্রত্যাশায় নয়,কেবল মনের শান্তির জন্য আলিসা সেই বৃষ্টির কাছে নিজেকে ধরা দিতে চাইল।সাংসারিক সুখ যখন একজন অংকুরে বিনষ্ট করে দেয় আলিসার মতো অনেকে পুরোনো হলেও অন্য কারোর কাছে সেচ্ছায় ধরা দিতে চাই।হোক সেটা নিজেকে একটুখানি সুখের বৃষ্টিতে ভিজিয়ে মনকে শান্তিমত প্রস্তুত করার জন্য। কাউকে সে বিপদের সময় পাশে পাওয়ার আশায়।


লেখিকা,
সর্ণালি রহমান শারমিন
গল্পকার ও কথা সাহিত্যিক

Comments