বিভ্রম যাত্রা




রেল স্টেশনে দাড়িয়ে কাঙ্খিত পথ যাত্রার ট্রেনের জন্য অপেক্ষমান রুদ্র বসন্তের রাতে হালকা বাতাসে বেশ লাগছে আবহাওয়া। রাতের মিটিমিটি আলো স্টেশনের বাতির আলোর সাথে মিশে চারদিক অনিন্দ্য সুন্দর দেখাচ্ছে। রেল স্টেশনের মানুষ গুলো একে অপরের সাথে আলাপ জমিয়ে দিয়েছে। যখনই কোনো ব্যক্তি এসে সহযোগীতা চাচ্ছে খুব সুন্দর ভাষায় মিষ্টি সুরে সহযোগীতার চেষ্টা করছেন স্থানীয়রা। আসলে এভাবে কখনো রাতের বেলা বাড়ির বাহিরে থাকা হয়নি রুদ্রের। মানুষের রাত্রীকালীন ব্যবহার দেখার সুযোগ মিলেনি। মিলবেই বা কোত্থেকে? মাগরিব না গড়াতেই বাড়ির চার দেয়ালে হতে হয় বন্দী। খেলাধুলার জন্য মাঝেমধ্যে মাগরিবের পর বাড়ি ফিরলেই বাবার আড়চোখে বাঁকা নজর, মায়ের বকাঝকা শুনতে বেশ খারাপ লাগতো তার। রুদ্র কখনো বাবা-মায়ের আচরণে কষ্ট পেতে চায় না এবং বাবা-মাকেও কষ্ট দিতে চায় না। যার ফলে ইচ্ছে করলেও বাড়ির বাহিরে রাত কাটানো হয় না। সন্ধা নাগাত নাস্তা সেরে পড়ার টেবিলে। পড়া শেষে বাবা-মায়ের সাথে আড্ডা; এভাবেই কেটে গেলো রুদ্রের ১৮ বছর বয়স। বাবামায়ের অনুগত ছেলেটি কৃতিত্বের সহিত এন্টার পাশ করে জীবনের প্রথম বারের মত নিজের স্বপ্নের জগতে পা রাখতে মাগরিবের পর একাকী বাড়ির বাহিরে। যেতে হবে অনেকদূর; গন্তব্য দিনাজপুর জেলা থেকে  সুদূর ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়। ট্রেনের সময় রাত এগারোটা হলেও অতি সতর্কতা বশতঃ সাড়ে নয়টা না পেরুতেই বাড়ি থেকে বের হয়ে আসছে। স্টেশনে দাঁড়িয়ে ট্রেনের অপেক্ষা করছে; ভাবছে জীবনের প্রথম একাকী বাড়ি থেকে বের হওয়ার কথা। দেখছে পাশের মানুষ গুলোর নানান আচরণ।  ভিক্ষুক ভিক্ষা চাইছে; পাগল করছে পাগলামি; কুলি টানছে বোঝা; যাত্রীর চেহারায় যাত্রার চাপ; হোটেল বয় ডেকে বলছে, খেয়ে যান খাবার; পুলিশের কাজ পুলিশ করছে, লোকে দিচ্ছে গালি। কি বিচিত্র পরিবেশ! কিন্তু এই বিচিত্রতায় রুদ্রের মন তেমন সায় দিচ্ছে না। মাথায় একটাই চিন্তা; কখন আসবে ট্রেন? কখন নিজের আসনে বসে বাবা-মাকে ফোন দিয়ে বলবে আমি ট্রেনে উঠলাম? কখন পৌঁছাবো গন্তব্যে? কেমন হবে পাশের সিটের যাত্রী? মহিলা নাকি পুরুষ? সুন্দরী রমণী হলে বেশ হয়; রমনীর কথা মাথায় আসতেই বুক দুরু দুরু। কখনো কোনো মেয়ের সাথে একান্তে মন খুলে কথা হয়নি। বলা হয়নি নিজের ভালো লাগার গল্প। সেই ক্লাস টেনে থাকাকালীন গ্রুপের সাবজেক্টের কুচিংয়ের সুবাদে সহপাঠী চন্দ্রার সাথে ক’দিনের আলাপ। সেই আলাপে কেবলই ছিলো পড়াশোনা আর পড়াশোনা; তবে ফাঁকে ফাঁকে উচ্চশিক্ষার জন্য কে কোথায় যেতে চায় তা নিয়ে গল্প হতো। এসএসসি পরিক্ষা গনিয়ে আসায় কোচিংয়ের অবসান ঘটলো। এইচএসসিতে রুদ্র ভর্তি হলো বয় কলেজে। ফলে তেমন কোনো মেয়ে বান্ধবী নাই। তার জীবনে নারী জগতে একমাত্র মায়ের সাথেই  একান্তালাপ; এছাড়াও খালা ফুফীদের সাথে বেশ আড্ডা হতো তার। কিন্তু বিশেষ কোনো রমনীর সাথে সখ্যতা না থাকায় মেয়ে দেখলেই তার মধ্যে আনাড়ী ভাব আসে। অপরিচিত কোনো মেয়ের সাথে কথা বলতে গেলেই লজ্জ্বায় বিকিয়ে আসে।

নানান চিন্তা নিয়ে রুদ্র বারবার তাকাচ্ছে ট্রেন আসার পথের দিকে। কখন আসবে ট্রেনআর তর সইছে না। সময় যেনো স্থির হয়ে আছে। কোনো ভাবেই সামনে গড়াচ্ছে না। চটফট করছে চিন্তার জগত। ব্যাগ কাঁধে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়। ট্রেনের সময় এগারোটা কিন্তু এখন রাত বারোটা গড়িয়ে প্রায়। বিরক্তির সব ছায়া মেঘ হয়ে জমেছে রুদ্রের কপালে। রুদ্রের অস্থিরতা দেখে পাশ থেকে একজন বললো বাবা অস্থির হইয়োনা, এটা বাংলাদেশ। এখানে আগের দিনের নয়টার গাড়ি পরদিন আটটা পঞ্চান্ন মিনিটে আসে। ধৈর্য্য হারিয়োনা। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেনে চলে আসবে। প্রায় সবসময়ই এগোরোটার গাড়িটা বারোটায় আসে। রুদ্র ঘড়ি দেখে এখনো বারোটা বাঁজতে আঠারো মিনিট বাকি। মানসিক ভাবে এখন এগোরোটা ছেড়ে বারোটার অপেক্ষা করছে। হঠাৎ চোখে পড়লো আবছা আলো; হয়তো ট্রেন আসছে। হ্যাঁ, হর্ণ বাঁজাতে বাঁজাতে ট্রেন স্টেশনে এসে পৌঁছলো। পকেট থেকে টিকেট বের করলো। দেখে নিলো নিজের বগি নাম্বার ও সিটের অবস্থান। ট্রেন থামতেই সিরিয়ালে খুঁজতে থাকলো চ’ নাম্বার বগি। মাইনসের লগে ঠেলাঠেলি করে ট্রেনে উঠলো; এবার খোঁজার পালা ৫৬ নাম্বার আসন। আসনে গিয়ে দেখে বসে আসে লম্বা চুলের এক উদ্ভট যুবক। দেখতে কেমন যেন? মনে হয় বখাটে প্রকৃতির একজন। হয়তো মদ গাঁজা খায় নয়তো মানুষকে এতো বিশ্রি লাগার কথা না। ভয়ে ভয়ে বললো ভাইয়া সিটটা আমার। দয়াকরে আমাকে বসার সুযোগ দিন। রুদ্রের দরদমাখা কথা শুনে যুবক দাড়িয়ে সিট ছেড়ে দিলো। রুদ্র ব্যাগটা লোহার তাকে রেখে সিটে বসেই ফোন করলো বাবাকে। বাবার সাথে কথা বলছে; এদিকে শোনা যাচ্ছে মা বলছে আমিও কথা বলবো। বাবার সাথে আলাপ শেষে মায়ের সাথে কথোপকথন। হ্যালো আম্মু বলতেই মায়ের কণ্ঠ থেকে ভেসে আসলো বাবা কেমন আছো? ক্ষুধা লাগেনিতো? ক্ষুধা লাগলেই ব্যাগ থেকে পিঠা বের করে খেয়ে নাও। তোমাকে না জানিয়েই ব্যাগের সেকেন্ড পকেটে পিঠা,পানীয় ও বাদাম দিয়ে দিয়েছি। বাদাম রুদ্রের অত্যন্ত পছন্দের খাবার; তাই তার মায়ের এহেন কান্ড। অথচ রুদ্র জানেই না ঘরে বাদাম আছে। রুদ্র মাকে জিঙ্গাসা করলো, ঘরে বাদাম আসলো কোত্থেকে? মা উত্তর করলেন, ট্রেনে বসে থাকতে থাকতে তোমার অসস্থি লাগবে জানি। তাই সে সময় যাতে বসে বসে বাদাম খেতে পারো তাই তোমার বাবাকে বলেছি বাজার থেকে বাদাম নিয়ে আসতে। এই প্রথম বারের মত রুদ্র তার প্রতি মায়ের আদর টের পেলো। আসলে মায়ের আঁচল থেকে  বের না হলে মায়ের মর্ম ও টান বুঝা যায় না। রুদ্র বাসা থেকে বের না হতেই মায়েরা টান উপলব্ধি শুরু করলো। নানান উপদেশের মধ্যদিয়ে মায়ের সাথে কথোপকথন শেষ হলো।

মোবাইলটা পকেটে রেখে একটা স্বস্থির নিঃশ্বাস ছাড়লো। পাশের সিটের মুরুব্বিকে সালাম দিয়ে বললো, চাচা কোথায় যাবেন আপনি? চাচা উত্তর করলো, এইতো সামনের স্টেশনেই নামবো। ট্রেন থেকে নামার আগে চাচা রুদ্রের সব জেনে নিলো। একাকী প্রথম জার্ণি ও বাসা থেকে বের হওয়ার কথা শুনে রাস্তায় চলার পথের কিছু করণীয় বলে দিলো। মুরুব্বি চাচাকে বেশ মনে ধরলো রুদ্রের। সামনের স্টেশনে পৌঁছতেই মুরুব্বি চাচা ’ভালো থেকো, সতর্কতার সহিত ভালো ভাবে যেও’ বলে নেমে গেলো। চাচা নেমে যাওয়ার পর রুদ্র চাচাকে মিস করতে শুরু করলো। মাত্র আধা ঘন্টার পরিচয়ে কথা হলো। বিশেষ কিছু উপদেশ পাওয়া গেলো। এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যায়। চাচার একটা কথা বারবার মনে পড়ছে,’’বাবা, রাতের বেলা পথে ঠগবাজ থাকে, সাবধানে লোক দেখে চলিও’’। ঠগবাজের কথা চিন্তায় আসতেই রুদ্রের মধ্যে ভয় কাজ করতে শুরু করলো। মনে মনে ভাবলো, বাবা সাথে থাকলে ভালো হতো। কিন্তু বাবাতো অফিসের কেরানী; চাইলেই ছুটি কাটাতে পারেনা। অফিসের কেরানীরাই যেন জগতের সব কাজের মহানায়ক। সকল কাগজাদী তাদের হাতেই লিখা হয়।
 একদিনের অনুপস্থিতেই অফিসের বহু জরূরী কাগজ হারিয়ে যায়। কেরানী অনুপস্থিত মানে অফিসের সব কাজ যেন স্থবির। কেরানী বাবার পক্ষেতো আর দু’তিন দিন ছুটি কাটানো সম্ভব না। যাইহোক, কেরানী বাপজান কষ্টসাধ্য করে ছেলেকে ঢাকা ভার্সিটি পরিক্ষার জন্য পাঠাচ্ছে এটাও বা কম কিসে। মধ্যভিত্ত শ্রেণির পথ চলাটাই এমন। তাই রুদ্র নিজেকে মানিয়ে নিলো। ভাবছে কমলাপুর স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে কিভাবে ভার্সিটিতে এলাকার বিপুল ভাইয়ের কাছে গিয়ে পৌছবে। ভাইয়ের কাছে না পৌছা পর্যন্ত স্বস্তি নেই রুদ্রের। এই প্রথম ঢাকায় যাত্রা। কেমন হবে শহর? কেমন হবে শহরের মানুষ গুলো? কিছু জানতে চাইলে ঠিকঠাক বলবেতো তারা? এতদ চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আসলে একাকী থাকলে আনাড়ী মনে যেসব চিন্তা ঘুরে তাই হচ্ছে আরকি। একা একা আর কতক্ষণ চিন্তা করা যায়? কতক্ষণই বা নিজে নিজে গল্প করা যায়? ব্যাগ থেকে বাদাম বের করে খোঁসা ছাড়িয়ে বাদাম খাচ্ছে। কিন্তু কেন জানি বাদাম খেতে ভালো লাগছেনা। পানি খেয়ে সিটের সাথে এলান দিয়ে প্রশান্তি খুঁজছে। জানালায় তাকিয়ে দেখে কালো আবছা আলোয় ঘিরে আছে গ্রামগঞ্জ। দূর আকাশে দেখা যাচ্ছে তাঁরার মেলা। বসন্তের বাতাসে শরীরটা মোলায়েম হয়ে আসছে, যেন ঘুম আসবে।

হঠাৎ কোমল কণ্ঠে ডাক পড়লো, হ্যালো ভাইয়া! শুনছেন? উঠুন! আপনার পাশের সিটটা আমার; আমাকে বসতে দিন। চোখ মেলে চোখ মুছতে মুছতে দেখে দাড়িয়ে আছে এক সুন্দ্রী রমনী। চোখ দুটো টানা টানা। মাস্ক পরায় চেহেরা তেমন বুঝা যাচ্ছেনা। তবে ফেস বেশ ফর্সা সুন্দর বলে মনে হয়েছে। রুদ্র দুঃখিত বলে উঠে পাশের সিটে মেয়েটিকে বসতে দিলো। ট্রেন দাড়িয়ে আছে। বাহিরে তাকিয়ে বিলবোর্ড দেখছে। জানার চেষ্টা, কোথায় আসলাম? আর কতপথ বাকি? অবেশেষে মুদি দোকানের বিলবোর্ডে নজর পড়লো, বড় লাল অক্ষরে লেখা আছে ”করিম স্টোর”
 মাঝে মাঝারী অক্ষরে লেখা আছেএখানে চাল ডালসহ সকল মুদি মাল এবং স্টেশনারী মালামাল খুচরা বিক্রি করা হয়; নিচে হলুদ অক্ষরে সাজিয়ে ছোট করে লেখা ত্রিমোহিনী, গাইবান্ধা। তার মানে এখন গাইবান্ধা আছি। মাত্র গাইবান্ধামনে হলো যেন লম্বা ঘুম দিয়েছি; ভাবলাম হয়তো সিরাজগঞ্জ যমুনা সেতু পেরিয়ে গেছি যমুনা সেতু দেখার বেশ সখ দেশের গৌরবোজ্জ্বল অর্জন বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু যাক সেতু পেরিয়ে যাইনিসেতু দেখার সুযোগ আছেএটা ভালো খবর কিন্তু এখনো মাত্র নওগাঁএটা খারাপ খবর একাকী জার্ণির পথ নাকি শেষ হতে চায় নাএখন তাই দেখছি এসব ভাবতে ভাবতে সীটে বসলো বসতেই নিজের মধ্যে কেমন যেন অনুভূত হলো আর বুঝি যাত্রা উপভোগ করা হলো নাপাশের সিটে মেয়ে বসে আছে নিজের মধ্যে কেমন লজ্জ্বা লজ্জ্বা ভাব কাজ করছে আপন মনে চারিদিকে মানুষ গুলোকে দেখছে কেউ ট্রেন থেকে নামছেকেউ ট্রেনে উঠছে হকাররা নিজেদের ব্যবসায়িক কাজ করে যাচ্ছে এতো রাতেও হকার দেখে রুদ্র চমকে যাবার কথা থাকলেও চমকে না উঠে স্বাভাবিক নিলো সে ইতোপূর্বে দেশের মানুষের জীবন যাত্রার মান জেনে নিয়েছে রুদ্রের চিন্তার জগতে মানুষের নানান প্রকৃতির অস্বাভাবিক কর্মের স্থিরচিত্র সেট আপ দেয়া আছে হর্ণ দিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিলো রুদ্র পুনরায় ঘুমানোর চেষ্টা করলো কিন্তু কিছুতেই চোখে ঘুম আসছে না চোখ বন্ধ করতেই পাশের সিটের মেয়েটির কথা মনে পড়ছে চোখ মেললেই মেয়েটিকে দেখতে পায় কিন্তু চোখ মেলে পাশ তাকিয়ে মেয়েটিকে দেখার সাহস হচ্ছে না মেয়েটি কোথায় যাচ্ছেএকাকী কেনোকি করেবাসায় কে আছেবাসা থেকে এমন একটা মেয়েকে একা ছাড়লো কি করেযেখানে আমি ছেলে হয়ে একা চলতে ভয় পাই সেখানে মেয়েটির সাহস তো কম নামেয়ে হয়েও রাত্রী বেলা একাকী পথ চলছেআসলেই মেয়েটিকে অনেক সাহসী মনে হচ্ছে রুদ্র এসব ভাবনার জগতে ডুবে আছে ”ঘুমিয়ে পড়েছেনএই যে ভাই শুনতে পাচ্ছেনঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?” মেয়েটির এমন বাক্যে স্তম্ভিত চোখ মেলে মেয়েটির দিকে তাকাতেই মেয়েটি সরি বলে উঠলো বললো আপনার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়েছি বুঝি রুদ্র প্রতিত্তুরে মেয়েটিকে স্বাগত জানালো বললো নাআমি ঘুমাই নি চোখ বন্ধ করে আছি মাত্র মেয়েটি বললো, ওহআচ্ছা
:
কোথায় যাচ্ছেন?
:
ঢাকা যাচ্ছি আপনি?
:
আমিও ঢাকা যাচ্ছি
:
বেশভালোই হলোগল্প করতে করতে ঢাকা চলে যাওয়া যাবে (সাহস করে রুদ্র বলে পেললো)
:
হুমম তো কোথা থেকে উঠলেন?
:
পার্বতীপুর দিনাজপুর থেকে তো ঢাকা যাচ্ছেন কার বাসায়?
:
ফুফুর বাসায় বিমানবন্দরের পাশেই ওনার বাসা আপনি কার বাসায় যাচ্ছেন?
ঢাকায় বাংলাদেশ ভার্সিটি ভর্তি পরিক্ষা দিতে যাচ্ছি
:
ওহআচ্ছা তারমানে আপনি এবছরই ইন্টার পাশ করছেনআমিও এবছর ইন্টার দিলাম ভালো রেজাল্ট পাইছি তাই ফুফু বলছে তার বাসায় বেড়াতে যেতে হবেই ওনি ভালো মন্দ খাওয়াবেঢাকার শহর ঘুরে দেখাবে
হুম এবছরই ইন্টার পাশ করলাম তাহলেতো আমরা এখন  ইয়ারমেট হয়ে গেলাম
:
হুমমম তাহলে এখন থেকে আমরা তুমি বলেই সম্বোধন করি?
হুমমম তবে তাই হোক
তো তুমি একা কেনসাথে কেউ থাকলে ভালো হতো নাএভাবে রাতের বেলা একা যাওয়া কি ঠিক?
আসলে ফুফু হঠাৎ বললো আজই যেতে হবে আগামীকাল নাকি ওনারা বেড়াতে যাবে তাই আজ রাতেই বের হতে হলো সমস্যা নাই আব্বু ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে গেছেসকালে ফুফু বিমান বন্দর স্টেশনে এসে আমাকে রিসিভ করবে এখন আর একা কইতুমিতো আছোই সাথে


তুমিতো আছোই সাথে” মেয়েটির এই কথাটা রুদ্রকে ভড়কে দিলো ভাবলোমেয়েটি বেশ মিশুক বটেনয়তো অল্প কমিনিটের আলাপে কেউ এভাবে বলে নাকি জানাশোনা নেইহঠাৎ দেখা অথচ কেমন আলাপ জুড়ে দিলো রুদ্র মেয়েটাকে নিয়ে পজেটিব নেগেটিব চিন্তা শুরু করে দিলো রুদ্রর চিন্তাযুক্ত ভাব দেখে মেয়েটি বললোকি ভাবছেন?
রুদ্রনা তেমন কিছুনা আসলে এতো কথা হলো অথচ আপনার নামটাই জানা হলো না
মেয়েটিআগে বলোআপনি বলা শুরু করলে কেনকি ভাবছিলে এতোক্ষণ?
রুদ্রনা তেমন কিছুই না হঠাৎ পরিচয়তোতাই তুমি করে বলাটা মানিয়ে নিতে সময় লাগছে আরকি যাইহোকতোমার নামটা কি?

মেয়েটিসাদিয়া মেহজাবিন স্বর্ণা সবাই স্বর্ণা বলেই ডাকে দাদু সাদিয়া মেহজাবিন নামটা রেখেছেন ওনি সাদিয়া বলেই ডাকে অন্যরা সাদিয়া না ডেকে স্বর্ণা ডাকায় দাদু খুবই রাগ করেন তো তোমার নাম কি?
রুদ্ররাইয়ান রাফাত রুদ্র সবাই রুদ্র নামে ডাকে তো ইন্টারে তোমার জিপিএ কতকোন বিভাগ থেকে পরিক্ষা দিছোকোথায় ভর্তি হবা?
মেয়েটিবিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ফাইভ পাইছি এখন নার্সিংয়ে ভর্তি হবো তোমার জিপিএ কতকোন বিভাগ থেকে?
রুদ্রমানবিক থেকে জিপিএ ফাইভ তুমি চাইলে মেডিকেলে ভর্তি হতে পারোনার্সিংয়ে কেনো?
মেয়েটিআসলে আমারো মেডিকেলে পড়ে ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা ছিলো কিন্তু,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
রুদ্রথেমে গেলো কেনোকিন্তু কি?
মেয়েটিসে এক লম্বা গল্প গত বছরের মার্চে আমার দাদা ভাই অসুস্থ হয়ে পড়লে দেশে অনেক ডাক্তার কবিরাজী ঔষধ সেবন শেষেও ফল হলোনা। অবশেষে ভারতের  ইন্দ্রপ্রস্থ অ্যাপোলো হসপিটালনিউ দিল্লিতে নিয়ে পরিক্ষা-নিরীক্ষা শেষে মরণব্যাধি ক্যান্সার ধরা পড়লো। চিকিৎসার সুবাদে দাদা ভাইকে দীর্ঘদিন দিল্লির হাসপাতালে থাকতে হলো। আব্বুর চাকুরি চাচার ব্যবসার কারণে এক টানা কেউই দাদা ভাইয়ের সাথে থাকতে পারতেন না। সপ্তাহ পনেরো দিন পর পর দেখে আসতেন এবং সকল প্রয়াজনীয় জিনিস গুলো কিনে দিয়ে আসতেন। সে সময়টাতে অনেকটা সময়ই দাদা ভাই দিল্লিতে একা ছিলেন। তখন হাসপাতালের নার্স মহিলারাই ছিলো দাদা ভাইয়ের কাছের লোক। তারাই দেখাশোনা করতেন। আব্বু বা চাচা যখন দেখতে যাইতেন তখন নার্সদেরকে অর্থ ও উপহার দিয়ে আসতেন। যাতে তারা ঠিকমতো দাদা ভাইয়ের দেখাশোনা করেন। হঠাৎ জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ”জন হপকিন্স মেডিসিনযুক্তরাষ্ট্র” থেকে ভারতে মিস্টার ফাইয়ান ডরোথী নামে এক ডাক্তার আসলেন। ইন্দ্রপ্রস্থ অ্যাপোলো হসপিটাল কর্তৃপক্ষের সাথে দাদা ভাইকে দেখানো হলে তিনি ভাইকে বাড়িতে নিয়ে আসার পরামর্শ দেন। পেসক্রিপশনে রঙ্গিন কলমে বিশেষ কিছু বার্তা দেন’ যা দেখে আমরা সবাই নিস্তব্ধ হয়ে যাই। বুঝতে আার বাকি নাই যে, দাদা ভাই আর বেশি দিন বাঁচবেন না। বাড়িতে নিয়ে আসার পর আমি প্রতিদিন সন্ধার পর দাদা ভাইয়ের সাথে গল্প জমাতাম। বিশেষ করে গল্পের বিষয় হতো নয়া দিল্লির হাসপাতালের স্মৃতি। প্রথম দিকে দাদা ভাই সেগুলো বলতে চাইতেন না; ফলে আমি বুঝতে পারলাম দিল্লিতে দাদা ভাইয়ের সময় ভালো কাটেনি। বুঝতে পেরে গল্প জানার জন্য পিড়াপীড়ি শুরু করলাম। দাদা ভাই এক পর্যায়ে বাধ্য হয়েই সেখানের কষ্টকর স্মৃতি গুলো বলতে লাগলেন...................
 ” শোন বোন। আমাকে যখন প্রথম রেখে আসা হয়েছিলো তখন আমি ছিলাম পুরোপুরি শয্যাশায়ী। সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হতো; বাম থেকে ডানে নড়ার জন্য হলেও নার্সদের হেল্প নিতে হতো। ডাক্তারের উচ্চ-মাত্রার চিকিৎসায় এবং নার্সদের যত্নে সপ্তাহ খানেকের মাথায় কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠি। নিজেকে স্বাভাবিক মনে হতে শুরু করলো। শরীর ভালো লাগায় স্রষ্টার সান্নিধ্যে যাওয়ার খুব ইচ্ছে হতো। ইতোস্ততবোধ নিয়েই একদিন এক নার্সকে বললাম আমি নামাজ পড়বো। আমাকে একটা জায়নামাজ বা চাদর দেয়া যায় কিনা। নামাজ পড়ার কথা শুনে নার্স মহিলাটার চেহারা কালো হয়ে গেলো। আসলে সিঁদুর পরা একজন মহিলাকে নামাজের কথা বললে চেহারা কালো হওয়া স্বাভাবিক। কেননা কোনো মুসলমানকে যদি হিন্দুদের পূজায় অর্থ দান করার জন্য বা পূজার স্থান বা মন্দির নির্মানের জন্য জায়গা দিতে বলে সে মুসলমান কখনোই সহযোগীতা করবে না; এটাই স্বাভাবিক। এটা ধর্মীয় বৈপরীত্যের ব্যাপার। এরপর আমি আর ওদের কাছে জায়নামাজ চাইনি। নিজে নিজে বেডের উপর বসেই কোনো রকম নামাজ আদায় করতাম। ক’দিন পর আমাকে হেল্প করার জন্য নিয়োজিত নার্স বদলীজনিত কারণে চলে গেলো। নতুন যে নার্স এলো তাকে আমার খুব একটা ভালো মনে হয়নি। সে ঠিকমতো দেখাশোনা করতো না। সময়মতো ঔষধ, খাবার কোনটাই দিত না। তার অবহেলা দেখে তোর চাচাকে জানালে তোর চাচা নার্সকে কিছু বখশিস দিয়ে ঠিকমতো সেবাযত্ন করার কথা বলে আসলো। এরপর ক’দিন ঠিকমতো দেখা শুনা করলেও পুনরায় আগের মত অবহেলা দেখাতে শুরু করলো। তার অবহেলার ফলে আমার অসুস্থতা আবার বেড়ে গেলো। অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়লাম। ঠিকমতো বিছানা থেকে উঠতে পারতাম না। টয়লেটে যাওয়ার জন্য নার্সের হেল্প নিতে হতো। কিন্তু নার্স মহিলাটা আমাকে হেল্প করতো চাইতে না। টয়লেটে যাব বললে তার চেহারা কালো হয়ে যেতো; তার হেল্প চাওয়ার ১৫/২০ মিনিট পর সে এগিয়ে আসতো। তার অবহেলার কারণে আমার খুব কষ্ট হতো। তখন মাঝেমধ্যে তোর বাবা-চাচা ও ফুফীর উপর খুব রাগ হতো। নিজে নিজে বলতাম তোরা যদি পাশে থেকেই চিকিৎসা করাতে পারবি না; তবে আমাকে একা নিঃস্ব অবস্থায় এতো দূরে রেখে গেলে কেনো? পরক্ষণেই ভাবতাম, আসলে তারা মরণব্যাধীতে আক্রান্ত তাদের পিতার সুস্থতার জন্য কমতো চেষ্টা করছেনা। হয়তো চাকুরি-ব্যবসার কারণে সময় দিতে পারছে না; মেয়েটাও স্বামীর সংসার শ্বশুর শাশুড়িকে দেখতে হয়
। মাঝেমধ্যে কষ্ট লাগলেও কখনো আমার সন্তানদের উপর রাগ হইনি। তবে যখন বুঝতে পারলাম নার্সদের অযত্নে আমার অবস্থা শোচনীয় তখন তোর বাবাকে বললাম আমাকে আরো কোনো ভালো জায়গায় নিয়ে যা নয়তো বাড়িতে নিয়ে চল। এরপরেই আমাকে আরো ভালো চিকিৎসা দেয়ার জন্য তোর বাবা-চাচা ও ফুফু অস্থির হয়ে পড়ে; অবশেষে আমেরিকান ডাক্তার মিস্টার ফাইয়ান ডরোথীর সংবাদ পেলে তাকে দেখানো হয়। কিন্তু ততক্ষণে আমার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেলো। যার কারণেই হয়তো ডাক্তার বলে দিয়েছে আমার সময় গণিয়ে আসছে। আমি হয়তো আর বেশি দিন বাঁচবোনা। দাদাভাই এভাবেই তার গল্প শুনাতে শুনাতে এক পর্যায় বললেন, ”বোন আমাকে একটা কথা দিবি? যতদিন বাঁচবি মানুষের মত মানুষ হয়ে বাঁচবি। মানুষের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গেও শান্তি আছে; পারলে সেটাই করবি। আমিতো জীবদ্দশায় কিছুই করতে পারলাম না। তুই বাজারের মোড়ের আমার জায়গাটায় একটা হাসপাতাল করবি। যাতে আমার এলাকার মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়। যাতে অন্তত আমার মত কিছুটা চিকিৎসা নিয়ে মরতে পারে”। সেদিন দাদভাইকে কথা দিয়েছিলাম, বাঁচলে মানুষের মত হয়ে মানুষের সেবা করেই বাঁচবো। এরপর প্রতি রাতেই চিন্তা করতাম কিভাবে মানুষের সর্বোচ্চ সেবা করা যায়? কখনো ভাবলাম জনপ্রতিনিধি হয়ে সেবা করবো; আবার কখনো ভাবলাম ডাক্তার হয়েই মানুষকে ফ্রী চিকিৎসা দিব। কিন্তু চিন্তা করে দেখলাম জনপ্রতিনিধি হলেতো আমি মানুষকে কিছুই দিব না বরং তাদের প্রাপ্যটাই তাদের দিব আর ডাক্তার হলে আমিতো শুধু প্রেসকিপশন লিখে দিয়েই চলে আসবো। ডাক্তার বা জনপ্রতিনিধি হয়ে মানুষকে সেবা করার চেয়ে আরো ভালো ভাবে সেবা করার চিন্তা করতে থাকি। একপর্যায় মনে পড়ে গেলো, নার্সদের কর্তৃক দাদা ভাইকে অবহেলার গল্প। মাথায় আসলো, আসলে একমাত্র নার্সই পারে নিজ হাতে অসহায় রোগীর সেবা করে সুস্থ করে তুলতে। তখনই সীদ্ধান্ত চূড়ান্ত করি যে, বাজারের রাস্তার মোড়ে দাদা ভাইয়ের জায়গাটায় একটা হাসপাতাল করবো এবং নিজ হাতে রোগীদের সেবা করবো। সে চিন্তা থেকেই নার্স হওয়ার সীদ্ধান্ত।

মেয়েটি গল্প শেষ করে চুপ করে রইলো। মেয়েটির কথা শুনে রুদ্র থ’ হয়ে গেলো, মুখ দিয়ে কোনো কথা আসছে না। কয়েক সেকেন্ড পর স্তম্ভিত ফিরে বললো, তুমি আসলে মহান মানুষ। তুমি নিশ্চয়ই অনেক সৌভাগ্য বাবার সন্তান। দোয়া করি স্রষ্টা যেন তোমাকে সফল করেন। আর তোমার দাদার জন্যও দোয়া রইলো। মেয়েটি রুদ্রকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললো, আচ্ছা তুমি কি হতে চাও? বড় হয়ে কি হবা?রুদ্র তার স্বপ্নের কথা জানালো। মেয়েটিও মনোযোগ দিয়ে রুদ্রের কথা গলাধকরণ করলো। এভাবেই নানান বিষয়ে কথা বলতে বলতে এক সময় মেয়েটির ঘুম পেয়ে বসলো। এদিকে ট্রেনও প্রায় বগুড়ার কাছাকাছি এসে পৌঁছালো।  রুদ্রের অনুমিত নিয়ে মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়লো। রুদ্রও চোখ বন্ধ করে মেয়েটির কথা চিন্তা করতে থাকলো। চিন্তা করতে করতে রুদ্রও ঘুমিয়ে পড়লো। হঠাৎ মোবাইলের রিংটোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গলো। মোবাইল বের করতেই দেখে স্ক্রীনে ভেসে আসলো বাবার নাম্বার। কল রিসিভ করতেই, ওপার থেকে মায়ের কণ্ঠ; কেমন আছিস বাবা? কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো? ট্রেনে ঘুমাতে পারছিস তো? কিছু খেয়ে নিছিস তো? এভাবে এক নাগাড়ে প্রশ্ন করে ই যাচ্ছেন। মায়ের সাথে কথা শেষ হলে বাহিরে তাকিয়ে দেখেন কোন এক মাঠের মধ্যদিয়ে ট্রেন নিরবধি চলছে। রাতের আকাশে চাঁদের আলো বেশ;জ্বলছে তারা সমূহ। রাতের আবহাওয়ায় বুঝা যাচ্ছেনা কতটুকু আসলো? মোবাইলের স্ক্রীনের আলো জ্বালিয়ে দেখে রাত তিনটা বেঁজে তেরো মিনিট। তারমানে সিরাজগঞ্জের আশে পাশে। মাথায় চিন্তা ডুকলো যমুনা সেতু পার হয়ে যাইনিতো। যমুনা সেতু দেখার ইচ্ছাটা প্রকট। টাকার মধ্যে সেতুর ছবি দেখছি; কত সুন্দর সেতু। বাস্তবে নিজ চোখে  দেখতে না পারলে কি হয়? বারবার বাহিরে তাকাচ্ছে; বুঝার চেষ্টা কোথায় আছি? কিন্তু রাতের বেলায় কিছুই বুঝা যাচ্ছেনা। হঠাৎ এক টিটি মামা বগিতে ডুকলেন। মামাকে দেখে রুদ্র বেশ আনন্দ ফিল করলো; মামাকে জিঙ্গেস করে নেয়া যাবে কোথায় আছি? মামাকে জিঙ্গেস করতেই বললো এখন নাটোরের চলনবিলের মধ্যে আছে; কিছুক্ষনের মাঝে সিরাজগঞ্জে পৌছাবো
। চলনবিলের কথা শুনতেই রুদ্র চমকে উঠলো। ওরে বইয়েতো চলনবিলের কথা পড়েছি। একটু দেখে নেয়া যাক। রাতের বেলা হওয়ায় চলন বিলের রাত্রীকালীন দৃশ্য দেখলো প্রকৃত দৃশ্য দেখা হলো না। যাইহোক রুদ্রের সকল আকর্ষণ তো যমুনা সেতু ঘিরে। রুদ্র এখন যমুনার সেতুর অপেক্ষা করছে। এদিকে মেয়েটি আপন মনে ঘুমাচ্ছে। জীবনে প্রথম বারের মত রুদ্র কোনো ঘুমন্ত মেয়ের দিকে তাকালো। মেয়েটিকে জাগ্রতের চেয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে। একনাগাড়ে মেয়েটিকে দেখছে আর নানান কথা ভাবছে। ভাবনার জগতে থাকতে থাকতেই ট্রেন সিরাজগঞ্জে ডুকলো। বিলবোর্ডে সিরাজগঞ্জ দেখা মাত্রই সকল চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে রুদ্র যমুনা খুঁজতে লাগলো। জানালায় তাকিয়ে আছে। এই বুঝি যমুনা সেতু এসে গেলো। সেতু দেখার অপেক্ষার তর সইছে না। জানালা দিয়ে মাথা বের করে দেয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু মেয়েটিকে ডিঙ্গিয়ে মাথা বের করাটা কেমন যেন মনে হলো রুদ্রের। হঠাৎ সামনে পড়লো গেইট। লেখা আছে বঙ্গবন্ধু সেতু টোল প্লাজা। ওয়াও, অবশেষে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু দেখার পালা আসলো। রাতের বেলা নাকি সেতু বেশি সুন্দর দেখায়। আমিও রাতের বেলা চাঁদের আলো ও তারা ঝিলমিলিতে সেতু দেখছি। বেশ আনন্দ উপভোগ্য হচ্ছে রুদ্রের। গেইট পেরিয়ে সেতুর উপর আসতেই মনের অজান্তে রুদ্র মেয়েটিকে ডিঙ্গিয়ে জানালা দিয়ে মাথা বের করে দিলো। আনমনে সেতুর সৌন্দর্য সম্ভোগ করছে। রুদ্রের শরীর মেয়েটির শরীরের সাথে আস্টেপিষ্টে গেলো; রুদ্রের নিঃশ্বাস পড়লো মেয়েটির গাড়ের উপর। নিঃশ্বাসের বাতাসে মেয়েটির ঘুম ভেঙ্গে গেলো। মেয়ের শরীরের সাথে রুদ্র মিশে থাকায় মেয়েটি ভয় পেয়ে উঠলো। ভয়ে মেয়েটি বাঁজে চিৎকার দিয়ে উঠলো। রুদ্রও ভয় পেয়ে গেলো। পাশের সীটের লোকজন গুলো রুদ্রদের দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করছে। কি হলো মেয়েটার? ছেলেটি কোনো আকাম করলো নাতো?মধ্য বয়সী একজন বলে উঠলো কি হয়েছে মা? মেয়েটি বললো না তেমন কিছু না; কি যেন স্বপ্নে দেখলাম তাই চিৎকার দিয়ে উঠছি। রুদ্র ভাবলো যাক এবারের মত বাঁচা গেলো। মেয়েটি যদি সত্যিই তার শরীরের সাথে আমার শরীরের চাপ অনুভব করার কথা বলতো তাহলে আমাকে আর ঢাকায় যেতে হতো না। লোকজন এখানেই মেরে ট্রেনের নিচে পিলে দিত। মনে মনে মেয়েটিকে ধন্যবাদ দিলো। স্বাভাবিক ভাবে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললো, দুঃখিত! আমি আসলে সেতু দেখতে গিয়ে জানালা দিয়ে মাথা বের করতেই তোমার শরীরের উপর চাপ লাগছে। বিশ্বাস করো আমি খারাপ কোনো উদ্দেশ্যে এমনটা করিনি। মেয়েটি চুপ করে রইলো। বুঝে উঠতে পারছে না; আসলে রুদ্রের  উদ্দেশ্য কি ছিলো? মেয়েটি আর তেমন কোনো কথা বললো না। চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরলো। রুদ্রও আর কোনো কথা বলার সাহস পেলোনা। সেতু দেখার স্বাদ জনমের মত মিটে গেছে। বুকটা ধুরুধুর করছে। কোনো উপায়ান্তর না দেখে রুদ্রও ঘুমের ভান ধরলো। ঘুমের ভানের মধ্যেই রুদ্র ঘুমিয়ে পড়লো। হঠাৎ কাঁধের উপর কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করলো। চোখ মেলে দেখে চারিদিকে আলো। মাঝবয়সী লোকটা বলছে, উঠো বাবা। ট্রেন কমলাপুর চলে আসছে। এখানে সবাইকে নামতে হবে। রুদ্রর মনে পড়লো সেই মেয়েটির কথা; না জানি কত খারাপ ভাবলো আমাকে? খুব অনুতপ্ত হলো। অনুভব করলো অদৃশ্য শূন্যতা। ভাবলো কত সুন্দর ভাবে আলাপ শুরু হলো! কত সুন্দর গল্পও জমে উঠলো! অথচ সেতু দেখতে গিয়ে কি একটা বাঁজে অবস্থায় পড়তে হলো। 

শেষ বারের মতো বলা হলো না ‘সরি’


চলবে,,,,,,,,,

লিখেছেন, ত্বোহা

Comments