আইন পেশায় আইনজীবীর দক্ষতা ও নান্দনিকতা

 




আইন পেশা হল পৃথিবীর সব অভিজাত পেশার অন্যতম। আর এ অভিজাত পেশার মানুষগুলোর নামের আগে ‘বিজ্ঞ’ শব্দটি ব্যবহার করতে হয়। অর্থাৎ ‘বিজ্ঞ আইনজীবী’ বলার মাধ্যমে এ পেশার আভিজাত্যকে ফুটিয়ে তোলা হয় অনিপুণ সৌন্দর্যে। এ পেশায় এসে আপনি অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারবেন, সমাজে সবার কাছে নিজেকে উপস্থাপন করার সুযোগ পাবেন এবং অর্জন করতে পারবেন সামাজিক প্রতিপত্তি, অবস্থান ও আর্থিক সচ্ছলতা। একটা সময় ছিল যখন আইন পেশা শুধুমাত্র সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর পেশা ছিল। কালের বিবর্তনে উচ্চবিত্ত শ্রেণীর পাশাপাশি মধ্যবিত্তরাও এই সম্মানিত পেশায় এসেছেন। এ পেশার মানুষগুলোই হবেন সমাজের অনুসরণীয় মডেল।


সাধারণ ভাষায় আইনজীবী বলতে আমরা সে সকল ব্যক্তিকে বুঝে থাকি যারা আইনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে নানা ধরনের মামলার পক্ষে-বিপক্ষে আদালতে দলিল, সাক্ষ্য ও যুক্তি পেশ করে মামলা নিষ্পত্তিতে সহায়তা করেন।


ফৌজদারি কার্যবিধি-১৮৯৮ এর ৪(১) এ বলা হয়, "উকিল", যে কোন আদালতে কোন কার্যধারার উল্লেখের সাথে ব্যবহৃত হয়, কোনও আদালতে প্রয়োগ করার জন্য যে কোনও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অধীন প্রণীত কোন প্রকার আইনজীবী ।


জেনারেল ক্লজেস এ্যাক্ট ১৮৯৭এর ৩ ধারার ২(ক) দফা মতে, Advocate বলতে এমন একজন ব্যক্তিকে বোঝায়, যিনি “The Bangladesh Legal Practitioners and Bar Council Order 1972 [P.O 46 of 1972]” এর অধীনে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। ... অর্থাৎ বার কাউন্সিল আইনের বিধান অনুসারে, বার কাউন্সিলে যাহার রোল আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত, তিনিই আইনজীবী।


দেওয়ানি কার্যবিধি ২(১৫) ধারা মতে,আইনজীবী বলতে এমন একজন ব্যক্তিকে বুঝায়, যিনি অপরের পক্ষে আদালতে উপস্থিত হবার এবং যুক্তিতর্ক পেশ করার অধিকারী।


আইনজীবী নিয়ে সুন্দর একটি উদ্ধৃতি  রয়েছে—-“Lawyers never lose,They either win or learn” অর্থাৎ“আইনজীবীরা কখনো হারেন না,তাঁরা জিতেন নয়তো শিখেন”

উল্লেখিত উদ্ধৃতিটুকু থেকেই আমরা বুঝে নিতে পারি একজন আইনজীবীর প্রচেষ্টা বা উদ্যম এর কোনো মাপকাঠি নেই।।আর তাঁদের এ উদ্যমী মানসিকতার জন্যই তাঁরা”ব্যবহারজীবী” বা “Legal Practitioner” হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছেন।


মানসিক প্রস্তুতিই হচ্ছে আইন পেশার প্রধান হাতিয়ার। যারা এই মহান পেশায় আসতে চান এবং যাদের স্বপ্ন এই পেশা ঘিরে, তাদের সবার আগে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই এগোতে হবে। কারণ এই পেশা অন্য সেবামূলক পেশা থেকে কিছুটা ভিন্ন। আইন পেশার শুরুটা একটু চ্যালেঞ্জের, একটু দুর্গম। তাই শুরু থেকে কঠিন পরিশ্রম এবং একাগ্রতা নিয়ে কাজ করার প্রস্তুতি নিতে হবে। তা ছাড়া এখানে আসার আগে আপনাকে 'রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন' কথাটার মর্মবাণীও মাথায় রাখতে হবে। রাজ্যের ধৈর্য নিয়ে আপনি বিচারপ্রার্থীদের সমস্যার কথা মন দিয়ে শোনার মানসিকতা রাখতে হবে।

এ পেশার শুরু হয় একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর সঙ্গে কাজ দিয়ে। প্রথমে আয়-রোজগারের দিকে না তাকিয়ে কাজের প্রতি মনোযোগী হতে হয়। একাডেমিক রেজাল্ট এখানে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ একাডেমিক ফলের চেয়ে আইন পেশায় পেশাজীবনের মেধা, পরিশ্রম ও ধৈর্যই হলো মুল। 


আইনজীবীদের দক্ষতা:

একজন আইনজীবীর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সম্বন্বয়ে দক্ষতা গড়ে ওঠে।

আমরা জানি,আইনজীবী শব্দের ইংরেজী অর্থ হলো ‘Lawyer’ যদিও এর আরো অনেক প্রতিশব্দ রয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে “LAWYER” শব্দটির_প্রতিটি_বর্ণের_ মাঝে লুকায়িত রয়েছে একজন আইনজীবীর দক্ষতাসমূহ।Elaboration টা একটু লক্ষ্য করা যাক।

L-Legal Expert= আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ

A-Analytical=ব্যাখাকারক

W-Wisdom=প্রজ্ঞা

Y-Youthful=তারুণ্যময়

E-Evergreen= সর্বদা সজীব ও সতেজ

R-Royalist=রাজকীয় ব্যক্তি


একজন আদর্শ আইনজীবী হতে গেলে দক্ষতা এবং বিচক্ষণতার কোন বিকল্প নেই।প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে একজন আইনজীবীর বিশেষ কিছু গুণাবলী অবশ্যই থাকতে হবে।

১. অধ্যাবসায়:

শুধু কর্মক্ষেত্রে নয়, এমনকি একজন আইনজীবী হওয়ার জন্য যে পড়াশোনা করতে হয় সেখানেও অধ্যবসায়ের কোন বিকল্প নেই।  তাই কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করার আগেই একজন আইনজীবীকে অধ্যবসায়ী হতে হয়। তাই পেশা জীবনে সফলতা পেতে একজন আইনজীবীর জন্য অধ্যবসায় এবং  দৃঢ়সংকল্পের কোন  বিকল্প নেই।




২. সৃজনশীলতা:

একজন ভাল আইনজীবীরা শুধুমাত্র লজিক্যাল এবং বিশ্লেষণাত্মক ক্ষমতা থাকলেই চলবে না। তার মধ্যে  যে কোন সমস্যার সমাধানের জন্য দুর্দান্ত সৃজনশীলতাও থাকতে হবে।আইনজীবীর অন্যতম যোগ্যতা হলো, “একজন আইনজীবীকে সবগুলো বিষয়ের কিছু জানতে হবে,কিন্তু কিছু বিষয়ের সব জানতে হবে।”



৩.  বিশ্লেষণাত্মক দক্ষতা

আইন বিষয়ে অধ্যয়ন এবং অনুশীলন উভয় ক্ষেত্রেই তথ্য নিয়ে প্রচুর পরিমাণে বিশ্লেষণ করতে হয়। অনেক সময় একাধিক যুক্তিসঙ্গত উপসংহারে পৌছাতে হয় এবং একটি পরিস্থিতির সমাধান করার জন্য একাধিক উদাহরণ টানতে হয়। সুতরাং একজন আইনজীবীর অবশ্যই সবচেয়ে উপযুক্ত উদাহরণ তুলে ধরা এবং তা মূল্যায়নের দক্ষতা থাকতে হবে।

৪.  গবেষণা দক্ষতা:

একজন আইনজীবীর ক্লায়েন্টদের চাহিদা বুঝা এবং সে অনুযায়ী আইনি কৌশল প্রস্তুত করার জন্য দ্রুত এবং কার্যকরভাবে গবেষণা করতে সক্ষম হওয়া আবশ্যক। আইনি কৌশল প্রস্তুতির জন্য প্রচুর তথ্য বিশ্লেষণ এবং বোঝার সক্ষমতা থাকতে হবে এবং, সেগুলিকে কার্যকর করতে জানতে হবে।

৫.  মানুষের সাথে চলার দক্ষতা:

আইন কোন বিমূর্ত পেশা নয়। দিন শেষে আইনজীবীদেরকে জনগণের সাথে কাজ করতে হয়, জনগণের পক্ষ হয়ে কাজ করতে হয়,  যে সিদ্ধান্ত গুলো জনগণের জীবনকে প্রভাবিত করে তা  নিয়েই কাজ কতে হয়। তাই একজন ভাল আইনজীবির  মানুষকে বুঝাতে এবং বুঝতে সক্ষম হতে হবে। এটি তাকে বিচারকদের প্রতিক্রিয়া বুঝতে এবং সাক্ষীদের সততা নিরুপণ করতে সহায়তা করে।

৬ যোগাযোগ দক্ষতা:


একজন আইনজীবীকে অবশ্যই কথোপকথনে চৌকশ হতে হবে। এছাড়াও ভাল লিখিত যোগাযোগ দক্ষতা থাকতে হবে এবং ভাল শ্রোতা হতে হবে। আদালতে জুরি এবং বিচারকদের সাথে যুক্তি তর্কে জয়ী হওয়ার জন্য পাবলিক স্পিকিং এর দক্ষতা অপরিহার্য। যোগাযোগ এবং কথা বলার দক্ষতা সমূহ মোটিং বা  জনসাধারণের সাথে কথোপকথনের মতো ক্রিয়াকলাপ গুলিতে অংশ নেয়ার মাধ্যমে অর্জন করা যেতে পারে। একজন আইনজীবীকে অবশ্যই পরিষ্কারভাবে, যথাযথভাবে এবং সংক্ষেপে লিখতে সক্ষম হতে হবে, কারণ তাকে প্রায়শই বিভিন্ন আইনি দলিল তৈরি করতে হয়। ক্লায়েন্ট  কী বলছে তা বিশ্লেষণ করতে বা জটিল সাক্ষ্য অনুসরণ করতে সক্ষম হতে হবে এবং একজন আইনজীবীর অবশ্যই ভাল শ্রবণ দক্ষতা থাকতে হবে।

৭.  বিচার করার ক্ষমতা:


অনেক সময়ই ক্লায়েন্ট হয়ত মামলা সম্পর্কে আপনাকে খুব বেশী তথ্য দিতে পারবে না। কিন্তু সীমিত তথ্য নিয়েই যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে বা সম্ভাব্য ফলাফল অনুমান করতে সক্ষম হতে হবে। একজন আইনজীবি হিসাবে এই গুণটি থাকা অপরিহার্য এছাড়াও আপনার নেয়া সিদ্ধান্ত গুলো সমালোচকদের দৃষ্টিতে বিবেচনা করতে সক্ষম হতে হবে যাতে আপনি আপনার যুক্তির সম্ভাব্য দুর্বলতা সমূহ ধরতে পারেন।  একইভাবে বিরোধী পক্ষের যুক্তির মধ্যে দুর্বল পয়েন্ট চিহ্নিত করতে সক্ষম হতে হবে।


৮.কৌশলগত দক্ষতা:

একজন আইনজীবীকে কৌশল জানতে হবে।তাকে ক্লায়েন্ট ম্যানেজ করত তার থেকে সত্য তথ্য বের করে আনতে এবং মামলায় সঠিক আইন প্রয়োগ করতঃ বিচারকের সামনে বিশেষ নান্দনিকতায় মামলা উপস্থাপন করে মামলায় জয় লাভ করার কৌশল জানতে হবে।

৯.সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী:

আইনজীবীকে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী জানতে হয়।তাকে সমাজের আপাদমস্তক বিশ্লেষণে একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের ভুমিকায় থাকতে হয়।ডাক্তার যেভাবে রোগীর রোগ নির্ণয় করেন,ঠিক সেভাবে আইনজীবীকে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী ও মামলার উৎস খুঁজে বের করতে হয়।


আইন পেশার নান্দনিকতা:

আইনজীবীর জ্ঞান,দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে পেশার নান্দনিকতা ফুটে ওঠে।

১.আইনজীবীগণ  আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ হয়ে থাকেন।তাদেরকে নতুন নতুন বিষয়ে খোঁজ রাখতে হয়।তাঁকে আইন জানতে হয় না,বরং সে আইনটি কোথায় রয়েছে তা  পরিষ্কারভাবে  জানতে হয় ।

২.আইনজীবীদেরকে হাজার হাজার আইন মুখস্ত করতে হয় না। আইনটি সময়মত সঠিক জায়গাতে প্রয়োগের দক্ষতা থাকতে হয়।

৩. সব বিষয়ে তার জ্ঞান থাকতে হয়।যদি গণিত বিজ্ঞানের মা হয়ে থাকে তবে আইন হবে বিজ্ঞানের বাবা!একজন দক্ষ আইনজীবীকে সর্বস্তরের জ্ঞান নিয়ে কাজ করতে হয়।

৪. একজন আইনজীবী হয়ে থাকেন তারুণ্যময়। তার কণ্ঠে থাকে মাধুর্য ও বলিষ্ঠতা।যেমন বাংলাদেশের প্রখ্যাত আইনজীবী রফিকুল হক ৫০ বছরের উপর কাজ করেছিলেন আইনজীবী হয়ে।উপস্থাপন করেছেন নিজেকে দক্ষতার সাথে।যিনি চির তারুণ্যের অধিকারী ছিলেন।মরেও বেঁচে আছেন আইন জগতে।

৫. একজন আইনজীবী হচ্ছেন একজন শিল্পী। আদালত হচ্ছে তাঁর জন্য মঞ্চ যেখানে সে তাঁর সবোর্চ্চ পরিশ্রমটুকু করেন অভিনয় সঠিক হওয়ার জন্য।নিজের ব্যক্তিত্ব,আত্নবিশ্বাসে বলিয়ান হয়ে একজন ভাল শিল্পীর মত হন যিনি বিচারককে মোহিত করেন তার অভিনয় শিল্প দিয়ে।


বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর প্রথম সংসদ অধিবেশনে ৫৫% আইনজীবীর প্রতিনিধিত্ব ছিল,এখনও মাননীয় রাষ্ট্রপতি জনাব আব্দুল হামিদসহ ৮/৯ জন মন্ত্রী এবং ৬০ এর অধিক সম্মানিত এমপি মহোদয় আছেন বর্তমান সংসদে যাঁরা আইনজীবী।


তাই একজন আইনজীবীর জীবন রাজকীয় সমতুল্য হওয়া উচিৎ।রাজার মত যিনি ভদ্র ও সাহসী।তাঁর নিজেকে প্রকাশ করা উচিৎ  রাজকীয়ভাবে আদালতে যিনি নিজেকে ছাড়িয়ে যান নিজের দক্ষতার মাধ্যমে।



লেখক,
মুহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত ত্বোহা
ইমেইল-tohaarafat1998@gmail.com
মোবাইল-01781704368


Comments