বিজ্ঞানী ডারউইনের মতবাদের অপনোদন


 চার্লস ডারউইন বিজ্ঞান ও দর্শন দিয়ে সৃষ্টির বিবর্তনবাদ প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। ডারউইন স্রষ্টার অস্তিত্ব মানতে নারাজ। তিনি বিবর্তনবাদ দিয়ে সৃষ্টির রহস্য ধারা তুলে ধরেছেন। ডারউইনের মতবাদটি পৃথিবীময় প্রসিদ্ধ এবং নাস্তিকদের জন্য দলীল স্বরূপ। জৈবিক বিবর্তনবাদ নিয়ে সর্বপ্রথম বিজ্ঞানী লেমার্ক তত্ত্ব আবিষ্কার করলেও ডারউইনের মতবাদ এতোই সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলো যে, ডারউইনের মতবাদের প্রতিভা লেমার্কের প্রতিভাকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়। ডার উইনের বিবর্তনবাদী মতবাদ নিয়ে বই ছাপা হলে মাত্র দুই ঘন্টার মধ্যেই সমস্ত কপি বিক্রি হয়ে যায়। নাস্তিকরা মনে করে ডারউইনের মতবাদের প্রচলন থেকেই দর্শনের কারামুক্তি হয়। তার আগে দর্শন ধর্মের অধীনে ছিলো বলে তাদের ধারণা। একথা সত্যি যে , ডারউইনের মতবাদের সবকিছু বিজ্ঞান গ্রহণ না করলেও তার মতের বেশ কিছু আজও দর্শন ও বিজ্ঞানে সমাদৃত আছে। অনেকেই অভিযোগ করেন, ডারউইন বলেছেন মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি। আসলে এই অভিযোগের সত্যতা আমি খুঁজে পাইনি। বরং ডারউইন যে মতবাদ দিয়েছেন সে মতবাদের একটি ধারা থেকে বানর ও মানুষ সৃষ্টি বলে তিনি ধারণা করেছেন। ডারউইনের মতবাদটি অনেকটা বাংলা ভাষার আবির্ভাবের ন্যয়। যেমন, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা থেকে বাংলা ভাষার সৃষ্টি। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশে ইন্দো একটি ভূখণ্ড ও ইউরোপীয় একটি ভূখণ্ড বিভক্ত হওয়াই এই ভাষাবংশ টিকে দুটি শাখাতে ভাগ করা হয়। একটি হচ্ছে "শতম" ও আরেকটি "কেন্তুম" । ভারতের মধ্যে "শতম" শাখায় কথা বলা হতো এবং ইউরোপের মানুষেরা "কেন্তুম" শাখায় কথা বলতো। যখন ভারতবর্ষে "শতম" শাখায় কথা বলা হতো, তখন ভারত বর্ষ একটি দেশ ছিল না, ভারতবর্ষ তখন একটি উপমহাদেশ ছিল। ভারতে অনেকগুলি জাতি থাকায় তারা আলাদা আলাদা ভাষায় কথা বলতো। যেমন আরবের জাতিরা "আরবীয়" ভাষায়, মিশরীরা "মিশরীয়" ভাষায় কথা বলতো, যারা ইরানের ছিল তারা "ইরানীয় ভাষায় কথা বলতো, ভারতীয়রা কথা বলতো "ভারতীয়" ভাষায়। ভারত অনেকটা বড় ছিল। তখন অন্য একটা দিক থেকে, একটি জাতি আসলো যা ভারত কে শাসন করতে লাগলো । সে জাতির নাম "আর্য"। আর্যদের শাসন করা কালীন, ভারতীয় আর্য ভাষা শিখে নিল। তখন ভাষাটি হয়ে গেল "ভারতীয়আর্য" ভাষা। ভারতীয় আর্যভাষা টি ভারতে ভাষার একটি রূপ। তখন সবাই "ভারতীয়আর্য" ভাষার কথা বলতে শুরু করে দিল। পরবর্তীতে কথা বলা এবং লেখা দুটো আলাদা হয়ে গেল। অঞ্চল ভিত্তিতে যে ভাষায় কথা বলা হত তাকে মুখের ভাষা বলা হয়, বইয়ের ভাষায় যাকে বলে "প্রাকৃত" ভাষা। মানুষ যে ভাষায় লিখিত অর্থাৎ লিখিত ভাষার নাম ছিল "সংস্কৃত"। মুখের ভাষা অর্থ প্রাকৃত ভাষা কে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হলো গৌড় অঞ্চলের যে ভাষায় কথা বলা হত তাকে বলা হল "গৌড়ীয় প্রাকৃত" এবং মগধ নামে যে এলাকা ছিল তারা যে ভাষায় কথা বলতো সেটির নাম ছিল "মাগধী প্রাকৃত"। সুনীতিকুমারের মতে বাংলা ভাষা এসেছে "মাগধী প্রাকৃত" থেকে দশম শতাব্দীতে। "গৌড়ীয় প্রাকৃত" থেকে বাংলা ভাষায় এসেছে সপ্তম শতাব্দীতে, এটি বলেছেন ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ । বাংলা ব্যাকরণে সুনীতিকুমারের কথাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। সুনীতিকুমারের মতে "মাগধী প্রাকৃত" হোক বা মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে "গৌড়ীয় প্রাকৃত" একসময় এই ভাষাটি বিকৃতি হয়ে যায়। ভাষা যখন ব্যর্থ হয় তখন সেটাকে বলা হয় "অপভ্রংশ"। এই বিকৃতি ভাষা থেকে সরাসরি একটি ভাষার উৎপন্ন হয় "বঙ্গকামরূপী"। "বঙ্গকামরূপী" যেটি "অপভ্রংশের" একটি রূপ। এখান থেকে সরাসরি কিছু ভাষা তৈরি হয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাংলা। এখানে বাংলা ভাষাটি যেভাবে ইন্দো-ইউরোপীয় থেকে বাংলা ভাষায় এসেছে ডারউইনের মতানুযায়ী ঠিক সে ভাবেই জীবকোষ বা জীবকোষ সমূহ থেকে পরিবর্তিত হতে হতে জীবের মানুষ্যরূপ এসেছে। কথা হলো মানুষের প্রয়োজনে ভাষার আবির্ভাব কিন্তু কার এমন কিসের প্রয়োজন ছিলো যে জীব কোষ আবিষ্কার করে মানুষ সৃষ্টি করতে হবে?  ডারউইনের  মতে, অত্যধিক হারে বংশবৃদ্ধি করাই হল জীবের সহজাত বৈশিষ্ট্য । এর ফলে জ্যামিতিক ও গাণিতিক হারে জীবের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় । জীবের জ্যামিতিক ও গাণিতিক হারে সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটার জন্য এবং খাদ্য ও বাসস্থান সীমিত থাকায় বেঁচে থাকার জন্য জীবকে কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয় । ডারউইন এই রকম সংগ্রামকে 'অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম' আখ্যা দিয়েছেন । জীবকে তিনটি পর্যায়ে এই সংগ্রাম করতে হয়, যথা : প্রথমত, অন্তঃপ্রজাতির সংগ্রাম, অর্থাৎ একই প্রজাতিভুক্ত বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যে সংগ্রাম । দ্বিতয়িত,  আন্তঃপ্রজাতির সংগ্রাম, অর্থাৎ যে কোনো দুই বা ততোধিক প্রজাতির মধ্যে সংগ্রাম । তৃতীয়ত,  প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম । এই তিন প্রকৃতির সংগ্রাম করে যারা জয়ী হয়েছে তারা টিকে আছে আর যারা জযী হয়নি তারা বিলুপ্ত হয়েছে। ডারউইনের মতে, পৃথিবীতে যে-কোনও দুটি জীব কখনই অবিকল একই রকমের হতে পারে না । অর্থাৎ জীবের মধ্যে কিছু না কিছু পার্থক্য বা ভেদ থাকবেই । ডারউইনের ধারণা অনুসারে ছোটো ছোটো ধারাবাহিক পরিবর্তনই হল নতুন প্রজাতির জীবের উত্পত্তির জন্য দায়ী । একটি বিশেষ জীবগোষ্ঠীর মধ্যে অনুকূল প্রকারণগুলি পুঞ্জীভূত হওয়ায় জীবের পূর্বপুরুষ ও উত্তরপুরুষের মধ্যে অনেক বেশি বৈসাদৃশ্য দেখা দেয় এবং এরই ফলে কালক্রমে একটি নতুন প্রজাতির উত্পত্তি ঘটে । বিবর্তনের ফলস্বরূপ জীব জগতে নতুন প্রজাতির জন্ম হয় । আর এভাবেই মানুষ সৃষ্টি হয়।


ডারউইনের মতবাদ নিয়ে কথা বলার যোগ্যতা আমার নেই। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র নই। বিজ্ঞানে তেমন কোনো জ্ঞানতো নেই’ই বরং জানাশোনাও শূন্যের কোঠায়। যাইহোক তবুও সাধারণ জ্ঞান, বুঝ ও অভিজ্ঞতা থেকে একটু ডারউইনের মতবাদটি কয়েকটি পর্যায়ে দেখার চেষ্টা করি। 


প্রথমত, ডারউইন বলেছেন জীব কোষ থেকে জীব-জন্তু বিবর্তন ধারায় পরিবর্তিত হতে হতে আজকের এই রূপে এসেছে। আমার কথা হলো যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে মানুষ কেন পরিবর্তিত হয়ে অন্য কোনো রূপ ধারণ করছেনা? আর যদি করেও থাকে তাহলে আর কত বছর পর অন্যরূপ ধারণ করবে? আমরা জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারবো তো?  আবার আমরা সবাই জানি, পৃথিবীতে সকল প্রাণী নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখতে সচেষ্ট থাকে। তাহলে যদি একটি প্রানী থেকে আরেকটি প্রাণীর রূপ হতো তাহলেতো প্রাণীর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠতো। তখনতো পৃথিবীতে অস্তিত্বের লড়াই চলতো। যে লড়াইয়ের ফলে পৃথিবী ধ্বংসযজ্ঞের আড্ডাখানা হতো। কিন্তু ইতিহাসেতো তেমন কোনো লড়াইয়ের গল্প শুনি না। 


দ্বিতীয়ত, ডারউইন বলেছেন যার লড়াই করে বেঁচে থাকার শক্তি বেশি সে বেশিদিন বেঁচে থাকে আর যার লড়াই করার শক্তি নেই সে বিলুপ্ত হয়ে যায়।  আমরা যদি পৃথিবীর প্রাণী জগতের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিক শক্তি সম্পন্ন জীব হলো মানুষ। কিন্তু মানুষ বাঁচে মাত্র এক শত বছরের মত। নিম্নমানের প্রাণী কচ্ছপ বাঁচে দুইশত বছরের উপরে । আবার বটগাছ বাঁচে পাঁচশত বছরের উপরে। হাজার বছরের উপরে বাঁচে এমন অনেক প্রাণীও আছে।


তৃতীয়ত, আমরা যদি জীব জগতের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো একটি অন্যটির উপর নির্ভরশীল। যেমন মৌমাছি মধু খেয়ে বেঁচে থাকে সুতরাং ফুল ও ফলের মধু বিলুপ্ত হলেতো মৌমাছি বিলুপ্ত হওয়ার কথা। 


চতুর্থত, ডারউইন প্রকৃতিতে মানবসত্তা আরোপ করে তার উপর বিচারের ভার দিয়েছেন। কিন্তু অচেতন প্রকৃতির পক্ষে বিচার করা সম্ভব? বিচার হলো বুদ্ধি দীপ্ত প্রক্রিয়া। যা প্রকৃতির নেই। 


পঞ্চমত, একটি প্রজাতি যখন অন্য প্রজাতিতে রূপান্তরিত হবে তখন নিশ্চয়ই তাদের দুই প্রজাতির মধ্যকার ভিন্ন একটি প্রজাতির জীবের আবির্ভাব হবে। কারণ বিবর্তন একদুই দিনে হয়না বরং হাজার হাজার বছর ধরে ঘটে থাকে। সুতরাং প্রকৃতিতে সেই সমস্ত অন্তর্বর্তীকালীন প্রজাতির দেখা মেলার কথা। কিন্তু বিজ্ঞানীদের যাবতীয় তত্ত্বের মুখে ছাই দিয়ে সারা পৃথিবীতে এ ধরনের একটাও মধ্যমর্তী জীব বা প্রানীকে খুঁজে পাওয়া যায় নি। তবুও মাঝে মাঝে এখানে সেখানে দুই একটা পুরাতন হাড় গোড় পাওয়া গেলে তা নিয়ে শুরু হয় লাফালাফি, অবশেষে দেখা যায় সব ধোকাবাজি, সত্যিকার মধ্যবর্তী কোন প্রাণীর দেখা মেলে না। দেখা মিলবে কি করে, সত্যি সত্যি মধ্যকার কোনো প্রানী থাকলে তো তার দেখা মিলবে। মানুষ তো দুরের কথা পৃথিবীর কোথাও আজ পর্যন্ত কোন প্রানীরই তাদের তথাকথিত পূর্বতন প্রানীর সাথে সম্পর্কিত মিসিং লিংকের কোন কংকাল পাওয়া যায় নি। তার মানে পৃথিবীর কোন প্রানীই অন্য কোন প্রজাতি থেকে বিবর্তনধারায় বিবর্তিত হয়ে আজকের রূপ পায়নি। প্রকৃতিতে যে জীব জন্তু দেখা যায় তা সবই স্বয়ং সম্পুর্ন, কোন জীবই অর্ধ বিকশিত বা অসম্পুর্ন নয়। প্রকৃতিকে মহান সৃষ্টিকর্তা যখন সৃষ্টি করেছিলেন তখন তিনি প্রতিটি জীবকেই সম্পুর্ন করেই সৃষ্টি করেছিলেন।এর কারন হলো অসম্পুর্ন জীব কখনই প্রকৃতিতে টিকে থাকতে পারতো না , বিকশিত হওয়া তো দুরের কথা। প্রকৃতি জগতে পশু, পাখী, কীট পতঙ্গ, গাছ পালা যা কিছু আমরা দেখি না কেন কোনটারই দৈহিক গড়নে ন্যুনতম ত্রুটি  দেখি না বরং দেখা যায় ১০০% সুষম দৈহিক গড়ন , যার যে অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ দরকার তার ঠিক তেমনটিই অছে, কারও একটা বেশীও নেই একটা কমও নেই।


ডারউইন বিবর্তনবাদের ব্যাখ্যায় বলেছেন, আদিম এক বা একাধিক জীব কোষ থেকে বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বর্তমান জীব জগতের উৎপত্তি হয়েছে। এজীব কোষ গুলো আত্ম বিভাজনের ফলে বংশ বৃদ্ধি করে চলেছে। কিন্তু কোষের আত্মবিভাজনের  নিয়মনীতি তিনি উল্লেখ করতে পারেন নি। তাই তার মতটিকে কল্পনা প্রসূত মনে করা হয়। ডারউইনের এই ঐতিহাসিক মতবাদটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমান সময়ের বিজ্ঞানীরা এর কঠোর সমালোচনা করে থাকেন। যাইহোক, আমি আমার আলোচনায় তার মতবাদকে ভুল বা শুদ্ধ প্রমাণ করা ইস্যু নয়। বরং তার মতবাদ থেকেই স্রষ্টার অস্তিত্বের দর্শন খুঁজতে চাই।  ডারউইন তার মতবাদে বলেছেন, আদিম এক বা একাধিক জীব কোষ থেকে বিবর্তন ধারায় মানুষ্যরূপ সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ কোথা থেকে সৃষ্টি হয়েছে এখানে সেটি আমার বিবেচ্য বিষয় নয় বরং জানার বিষয় হলো আদিম এক বা একাধিক জীব কোষ কোথায় থেকে এসেছে? কে সে জীব কোষ সৃষ্টি করেছেন? কিভাবে তা সৃষ্টি করা হয়েছে? তার বক্তব্যে মানুষ সৃষ্টির রহস্য জানলাম কিন্তু মানুষ সৃষ্টির উৎসমূল জীব কোষের উৎস কোথায়? এতদ প্রশ্নের উত্তর ডারউইন বা তার অনুসারী কেউ দিতে পারবেন কি? যদি দিতে না পারেন তাহলে আপনারা কি পরোক্ষ ভাবে স্রষ্টার অস্তিত্ব মেনে নেন নি। অবশ্যই স্রষ্টার অস্তিত্ব মানতে বাধ্য।  


Comments