আমার চার বছর বয়সী মেয়ে তমা আর বাবা টিভি দেখছেন। আমি আর মা বসে বসে গল্প করছিলাম। এরইমধ্যে চোখ গেলো টিভির একটা নিউজে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রী বন্ধুর হাতে ধর্ষণ।
টিভি স্ক্রিনে মেয়েটার চেহেরাটা ভেসে উঠলো, সঙ্গে ছেলেটারও। মা এবং বাবা দু'জনে একসঙ্গে বলে উঠলেন,ওইসব মেয়েটার দোষ, দেখো কি রকম ড্রেসে চলাফেরা করে। এতো খোলামেলা চললেতো যে কেউ আকৃষ্ট হবেই।
দুজন শিক্ষিত মানুষের এমন আচরণে আমি মর্মাহত হলেও ছোটবেলা থেকে দুজন মানুষকে ভীষণ শ্রদ্ধা করি বলে কিছুই বলতে পারলাম না।
ছোটবেলা থেকে উনারা আমাকে পর্দা করা শিখিয়েছেন।তারপরেও আমি যখন পর্দা করে বেরোতাম, কিছু বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ বোরকার উপর দিয়ে আমার সাইজ দেখে ঠিকই গিলে খেত, আর বাজেবাজে মন্তব্য করত।তখন বুঝেছি, ধর্ষণের ক্ষেত্রে পোশাক তেমন মেটার করেনা, মেটার করে মনুষ্যত্বের উপর। তবে ওসব কথা বাবা-মাকে তখন এতোটা বলার প্রয়োজন মনে করেনি।
ওনারা আমাকে শিষ্টাচার শিখিয়েছেন,তাই চুপ করে গেলাম।
নিউজ দেখে বাবা উঠে দাঁড়ালেন।মা কে বললেন, পোশাকটা এনে দিতে। মা পোশাক এনে দিতে বাবা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেন।
ধর্ষক কে আটক করেছে পুলিশ। তার হয়ে লড়ার জন্য উকিল খুঁজছেন তার পরিবার।
কিছুক্ষণ পর টিভিতে বাবার চেহেরাটা দেখলাম, উকিল সেলিম লড়ছেন ধর্ষকের হয়ে।
বাবা সাংবাদিকদের বললেন, নারী যদি পোশাক সচেতন হয় তাহলে ধর্ষণটা হতোনা। এই মেয়ে তো ওড়না ছাড়াই চলাফেরা করে। যা দেখে যেকোনো পুরুষের লালসা হবে। আর সবসময় তার সঙ্গ পাওয়া বন্ধুটির কি হাল হবে একবার ভাবুন। তার বন্ধুর নিশ্চয় তাকে দেখে ইগো হট হয়েছিল, মনে ফ্রাস্ট্রেশন কাজ করে ছিল। তারপরতো আমাকে বলতে হবেনা,আপনারা দেখলেন। এবার বলেন এখানে কার দোষ বেশি?
বাবার কথায় আমি মা'কে বললাম, মা বাবা ভুল কাজ করছেন। যে পুরুষের মনে পুরুষত্ববোধ নেই,নারীর প্রতি সম্মানবোধ নেই। যারা নারীকে সম্মান করতে জানেনা,যাদের মনে ধর্ম ভয় নেই শুধু শয়তানী বুদ্ধিতে চলে তারাউ এসব করে বুঝলে।
মা আমাকে বেশি বুঝবিনা বলে ভেতরে চলে গেলেন।
বাবা ধর্ষকের হয়ে কেইসটা লড়লেন, তবে জিতেছে কি-না জিজ্ঞেস করে দেখেনি। বাবার পেশার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধটা কাজ করেছিল না ঠিক।
এরপর মাঝখানে এক বছর পেরিয়ে গেলো। একদিন আমাকে আর বাবাকে ছুটতে হলো মাকে নিয়ে হাসপাতালে। মায়ের সিরিয়াস অসুখ।হাসপাতালে থাকতে হবে আমাকে।
আমার মেয়ে তমার দিখে খেয়াল রাখার জন্য বাবা দারোয়ান সজল কে বলে গেলেন। দারোয়ান সজল কাকা বাবার প্রায় সম বয়সী। বয়স পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্ন ছুঁয় ছুঁয় হবে।গত পনেরো বছর ধরে আমাদের বাড়িতে আছেন তিনি। তাই তমার নিরাপত্তার দিকটা বাবা তার আস্থাবাজনকে দেখতে বলেছিলেন।
সারারাত আমি আর বাবা হাসপাতালে পড়ে রইলাম। সকালে বাড়ি ফিরে দেখি সজল কাকা নাই।পুরো বাড়ি পাকা।
তমাকে খুজতে গিয়ে আমি প্রচন্ড রকমের ধাক্কা খেলাম। আমার মেয়েটা রক্তাক্ত হয়ে বিছানায় পড়ে আছে।
আমাকে দেখে বললেন, মা সজল, সজল।
বাকিটা আমি আর বাবা বুঝে নিয়েছিলাম।বাবা প্রচন্ড রকমের রেগে গেলেন সজলের উপর।
বললেন, এরকম জন্তু-জানোয়ারও হয় এই দুনিয়ায়। এই টুকু বাচ্চার ওপর লোভ সামলাতে পারলোনা! ওরে যদি আমি পাই তাহলে শেষটা দেখিয়ে ছাড়বো।
ঘটনা মুহুর্তে ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেশে।
বাবা তার ধর্ষিতা নাতনীর বিচার চায়।কিন্তু কে দাঁড়াবে তার হয়ে?
মানুষজন তখন অলরেডি বাবার ওপর ক্ষেপা। ওরা বলছেন, কেন মশাই, আপনিইতো বলেন, নারীর পোশাকে সমস্যা, এখানে সজলের কি দোষ? সব দোষ নিশ্চয় আপনার পাঁচ বছরের নাতনীর। যার চলাচলে সজল নিজের পুরুষত্বকে ধরে রাখতে পারেন নি। আপনি তার হয়ে লড়ুন, আপনার নাতনিকে বুঝিয়ে দেন, এই সমাজে সব দোষ তার, আর তার শরীরের। সজল পুরুষ, নারী দেখলে তার লোভ হবেই।
বাবা আজ চুপ,কোন কথায় বললেন না,শুধু বললেন আমি আমার নাতনীর বিচার চাই। সঙ্গে আমিও বললাম, বাবা এবার বলো, ধর্ষণের ক্ষেত্রে নারীর পোষাক দায়ী নাকি নারীর প্রতি পুরুষের মানসিকতা কেমন হওয়া উচিত সেটাই দায়ী?
লেখিকা,
স্বর্ণালি রহমান শারমিন
গল্পকার ও কথা সাহিত্যিক
Comments