বীরাঙ্গনার মর্যাদা নিশ্চিত হোক
”বীরাঙ্গনা”
শব্দটি অভিধানে ’বীর সাহসী নারী’ অর্থে ব্যবহৃত। বীর
সেনানী হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান পাওয়া রমনীদের বীরাঙ্গনা বলা হয়। ১৯৭১
সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হায়েনাদের যৌন লালসার শিকার ধর্ষিতা মা-বোনদের মর্যাদাকে অক্ষুন্ন রেখে জাতীর শ্রেষ্ঠ রমনী হিসেবে আখ্যায়িত করতে স্বাধীনতার মহান স্থপতি শহীদ রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তাদেরকে বীরাঙ্গনা উপাধি দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু
১৯৭২ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি পাবনা জেলায় সংস্কার করা বাঁধ উদ্বোধন করতে গিয়ে মঞ্চে উঠার সময় নারী কণ্ঠের আর্তনাদ শুনতে পান। কতিপয়
নির্যাতিত
নারী তাদের করুণ কাহিনি ও শোচনীয় অবস্থা বর্ণনা করতে আসেন। বঙ্গবন্ধু
তাদের সায় দিয়ে বলেন, ’আচ্ছা মা, বিষয়টি আমি দেখবো’। মঞ্চে
উঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আজ থেকে পাক বাহিনীর নির্যাতিত মহিলারা সাধারণ মহিলা নয়, তারা এখন থেকে বীরাঙ্গনা।মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান কম
নয় বরং কয়েক ধাপ উপরে। তাই তাদের বীরাঙ্গনা মর্যাদা দিতে হবে এবং সম্মান দেখাতে হবে। আর সেই সব পিতা ও স্বামীদের উদ্দেশ্যে বলছি যে, আপনারাও ধন্য। কেননা এ ধরনের মহৎ ও ত্যাগী মহিলার স্বামী বা পিতা হয়েছেন। হে বীরাঙ্গনা! তোমরা
আমাদের মা। ’’বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বক্তব্য থেকেই বীরাঙ্গনা উপাধি ভূষিত।বঙ্গবন্ধু অসহায় নারীদের জন্য “নারী পুণর্বাসন বোর্ড” গঠন করেছেন। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নারীদের ব্যাপারটি বিশেষ ভাবে স্থান দিয়েছেন। নারীদের জন্য ‘উইমেন্স ক্যারিয়ার ট্রেইনিং সেন্টার চালু করেছেন।মুক্তিযুদ্ধের সনদ পত্রে বীর শব্দের সাথে বীরাঙ্গনা শব্দও যোগ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর এতদ প্রচেষ্টা ফলপ্রসু হয়নি কারণ বীরাঙ্গনার গল্প অপরকে শোনানোর মত না। ফলে কেউ বীরাঙ্গনা পরিচয় দিয়ে নিজ অধিকার আদায় করতে চাননি।
আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাতে যাই, তাদের গল্প শুনি কিন্তু কখনো কি বীরাঙ্গনার গল্প শুনতে গিয়েছি? যারা শুনতে গেছেন, নিশ্চয়ই দেখেছেন ’বীরাঙ্গনা’ তার গল্প শোনান নি বরং নয়-ছয় গল্প বলে নিজ গল্প এড়িয়ে গেছেন। মানুষ দুঃখ-কষ্ট পায় অতঃপর তা অপরের সাথে শেয়ার করে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন। কিন্তু আমার বীরাঙ্গনা মা-বোনদের গল্প এমনই যে, যাহা অপরের নিকট বলার মত নয়। আহ! কি নিদারুণ গল্প!কি করুণ কাহিনি! আমরা প্রখ্যাত লেখিকা সুরমা জাহিদের ৩৬১ জন বীরাঙ্গনার মর্মস্পর্শী কাহিনি নিয়ে লেখা বই পড়লে দেখি, গাজীপুরের শ্রীপুরে ধর্ষনের ফলে এক বীরাঙ্গনার পায়ু পথ ছিড়ে গিয়েছিলো। কিন্তু তার তেমন চিকিৎসা হয়নি। কুমিল্লার ছোট্ট বয়সের এক বীরাঙ্গনাকে তুলে নিয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্পে এতো বেশি নির্যাতন করা হয়েছে যে, তার কোমরের হাড় ভেঙ্গে গিয়েছিলো। পরে তার বিয়ে হয়েছে কিন্তু ঘটনা জানার পর সংসার টেকেনি। ঠাকুরগাঁওয়ে এক বীরাঙ্গনার ক্যান্সার হয়েছে কিন্তু চিকিৎসার অভাবে তিনিও গত হয়েছেন। খাগড়াছড়িতে এক উপজাতী বীরাঙ্গনাকে মাসের পর মাস নির্যাতন করা হয়েছে। পরে সে বীরাঙ্গনাকে তার পরিবারও গ্রহণ করেনি। দুর্গম পাহাড়ে একা একা বাস করেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন।
বীরাঙ্গনাদের
অনেকেই আত্মহত্যা করেছেন, অনেকে দেশ ছেড়ে বাহিরে গৃহস্থালীর কাজে গমন করেন। অসংখ্য বীরাঙ্গনা অপ্রশিক্ষিত ধাত্রী দ্বারা গর্ভপাত করাতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আজকের বাংলাদেশে বীরাঙ্গনার সংখ্যা নিয়ে মতভেদ আছে,অনেক বলেন বীরাঙ্গনার সংখ্যা তিন
লাখ, কেউ বলেছেন দশ লাখ, ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন তার গবেষণায় বলেন, এসংখ্যা ছয় লাখের কম নয়। দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় প্রতিবেদনে আসে, এসংখ্যা চার লাখের কম নয়। মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীর সেবাদানকারী অজি ডাক্তার জিওপে ডেভিসের প্রতিবেদনে দেখা যায়, শুধু আন্তঃসত্ত্বা মহিলার সংখ্যাই দুই লাখ। গর্ভপাত করেছেন প্রায় এক লাখ সত্তর হাজার, বাকিরা প্রায়ই আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু আফসোস যে, এই বিশাল সংখ্যার বীরাঙ্গনা থেকে বিজয়ের পঞ্চাশ বছরে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রনালয় থেকে মাত্র চারশো আটত্রিশ জন বীরাঙ্গনাকে স্বীকৃতি দেয়া হলো। আমরা বিজয়ের কৃতিত্বটুকু বীরাঙ্গনাদের চরণে উৎসর্গ করতে পারিনি। সামাজিক মর্যাদা দেইনি। আমরা অনুভব করতে পারিনা যে, জীবন দেয়া সহজ কিন্তু সম্ভ্রম দেয়া সহজ নয়।
যুদ্ধ চলাকালীন এমনকি স্বাধীনতার পরেও আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বীরাঙ্গনাদের ধর্ষিতার চোখে দেখা হয়।সমাজ তাদেরকে এড়িয়ে চলেছে,পরোক্ষ ভাবে বয়কট করেছে।চিরাচরিত নিগৃহিত হয়েছে।পারিবারিক,সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবেও তারা উপেক্ষিত হয়েছে।আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের যেভাবে সম্মান দিয়েছি সেভাবে বীরাঙ্গনাদের সম্মান দিতে পারিনি।একাত্তরের বীরাঙ্গনাদের অনেকেই অর্থাভাবে মারা গেছেন।বহুলাংশে তাদের
মৌলিক ও মানবিক অধিকার নিশ্চিত হয়নি।
যাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ পেলাম,উন্মুক্ত আকাশ পেলাম,সেই আকাশ থেকে ফলিত রৌদ্র ও বারি বর্ষায় মাথা গোঁজানোর ঠাঁই তাদের হলোনা।স্বাধীন জমীন পেলেও সে জমিনে তারা স্বাধীন ও স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করতে পারেনা।ক্ষুধার জ্বালা,সম্ভ্রম হারানোর বেদনা,বদনাম,বয়কট,দুঃখ,কষ্ট,জ্বালা,যন্ত্রণা একাকার হয়ে তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করেছে।পরিবারে,সংসারে, সমাজে ঠাঁই হয়নি।বিয়ে হয়নি,বিয়ে হলেও সংসার হয়নি,সংসার হলেও শেষ রক্ষা হয়নি।একতরফা দোষী ও নির্যাতিত হয়েছে।নারী হয়ে জন্ম নেয়া এবং বীরাঙ্গনা হওয়া কি তাদের একমাত্র অপরাধ?
যারা বীরাঙ্গনাদের মর্যাদা দিতে কুণ্ঠাবোধ করে এমনকি বীরাঙ্গনাদের থেকে অন্যদের বেশি মর্যাদা দেয়, তারা আসলেই কুলাঙ্গার।বীরাঙ্গনা মানেই বাংলাদেশ।বীর রমণী,যারা স্বাধীন বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ অংশ তাদের সম্মান করা ও সম্মান নিশ্চিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।নচেৎ আমরা বাংলা মায়ের জারজ সন্তান বলেই বিবেচিত হবো।
আমাদের দেশের সরকার,মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সংসদসহ সকল বেসরকারী সংগঠন গুলো বীরাঙ্গনাদের ব্যাপারে সক্রীয় হতে হবে।সকল বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে।তাদের সম্মানী,নিরাপত্তা ও পরিবারকে পুণর্বাসন করতে হবে।মৃতদের মরণোত্ত্বর স্বীকৃতি দিতে হবে।তবেই নিজেদের বাংলা মায়ের প্রকৃত সন্তান হিসেবে পরিচয় দিতে পারবো।গর্ববোধ হবে।উচ্চকণ্ঠে বলতে পারবো,আমরা বীরাঙ্গনা বাংলা মায়ের সন্তান।
লেখক,
মুহাম্মদ
ইয়াসিন আরাফাত ত্বোহা
শিক্ষার্থী,ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল-tohaarafat1998@gmail.com
মোবাইল-01781704368
Comments