বাংলাদেশ সংবিধানে অবহেলিত অনুচ্ছেদ-"২ক রাষ্ট্রধর্ম





 বাংলাদেশ একটি একক,স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র।যা ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করে।স্বাধীনতাত্তোর ১৯৭২ সালের ২২শে মার্চ বাংলাদেশের সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতি "বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ" নামে একটি আদেশ জারি করেন।উক্ত আদেশের প্রেক্ষিতে খসড়া সংবিধান প্রণয়নের জন্য ১১ই এপ্রিল ১৯৭২ সালে খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়।১৯৭২ সালের ১২ই অক্টোবর সংবিধান প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান ও আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ড.কামাল হোসেন গণপরিষদে খসড়া সংবিধান উত্থাপন করলে ১৯৭২ সালের ৪ই নভেম্বর খসড়া সংবিধান গণপরিষদে গৃহীত হয়।উক্ত গৃহীত সংবিধানের ১৫৩টি অনুচ্ছেদের মধ্যে স্থান পায়নি "রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম"।শতকরা ৮৫ভাগ মুসলমানের দেশে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামের স্বীকৃতি না পাওয়াটা নিঃসন্দেহে উদ্বেগ ও হতাশার।বাঙ্গালী মুক্তির সনদ খ্যাত ঐতিহাসিক রেইসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই অমীয় বক্তব্যের চুম্বকাংশ ছিলো"মনে রাখবা,রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিব।এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ"। বঙ্গবন্ধুর 'ইনশাআল্লাহ' শব্দ উচ্চারণ স্বয়ং আল্লাহর প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস ও বাঙ্গালীর ইসলাম প্রিয়তার মূর্ত প্রতীক।মুক্তিযোদ্ধাদের দিন শুরু হতো ফজরের নামাজের মধ্য দিয়ে।নামাজ শেষে আল্লাহ'কে হাজির নাজির জেনে স্রষ্টার নির্ভরতায় স্বাধীন দেশের জন্য দোয়া করতেন।স্রষ্টার নির্ভরতায় দেশ স্বাধীন হলেও স্বাধীনতা পরবর্তী আল্লাহর বিধানকে সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়নি। সংবিধানের প্রস্তাবনায় (আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল সর্বশক্তিমান আল্লাহের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে;) উল্লিখিত হলেও ১৯৭৯ সালের ৬ই এপ্রিল সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মূলনীতির পরিবর্তন করা।রাষ্ট্রীয় মূলনীতি সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসের স্থলে ধর্মনিরপেক্ষতা'কে প্রতিস্থাপিত করা হয়।১৯৮৮ সালের ৯ই জুলাই তারিখে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়।রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে ইসলামকে সংবিধানে সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত হুসেন মুহাম্মদ এরশাদের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি এই ইসলামকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটা ছাড়া অন্য কিছু ছিলোনা। ১৯৮৮ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সারা বাংলাদেশ যখন উত্তাল, তখন ব্যক্তি জীবনে পরিপূর্ণ ইসলাম ধর্মের অনুশাসন মেনে না চললেও এরশাদ ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্মের স্বীকৃতি দেন। ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্মের মর্যাদা দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সহানূভূতি লাভের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকা।ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম স্বীকৃতি দিলেও আদৌ ধর্মীয় অনুশাসনের ব্যাপারে কেউই অগ্রগামী নন।স্বাধীনতা পরবর্তী অদ্যাবধি কাল পর্যন্ত যারাই রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন,তাদের সবাই নিজেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমান বলে দাবি করলেও রাষ্ট্রে ইসলামি শরয়ী বিধান বাস্তবায়নে সবাই বিমুখ।যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় গবেষণা সংস্থা পিইউ'র তথ্য মতে, বিশ্বের ২৮টি দেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম।মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠতায় বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম তুলে দেয়ার জন্য একটি মহল সর্বদা সোচ্চার।২০১৬ সালের ১৩ই নভেম্বর দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় নিউজ হয় যে,"সুযোগ পেলেই ‘সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ তুলে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, আমরা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্য। আমরা সব ধর্মের মানুষ একত্রে এ দেশে বসবাস করি। বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ, সম্প্রীতির দেশ"।

১৯৮৮ সালের ৫ জুন চতুর্থ জাতীয় সংসদে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী পাস হলে,সেই সংশোধনীতে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার ফলে ওই বছরই এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’র পক্ষে কয়েকজন নাগরিক রিট আবেদন করেন। ১৯৮৮ সালের রিট আবেদনের সঙ্গে ২৩ বছর পর ২০১১ সালে দাখিল করা এক সম্পূরক আবেদনের ওপর শুনানি শেষে ওই বছরের ৮ই জুন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল জারি করেন। রুলে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা সংবলিত সংবিধানের ওই সংশোধনী কেন অসাংবিধানিক ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। পরে একই বছরের ২৫ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম রেখেই সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদে সংশোধনী আনা হয়। ওই সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে সে বছরই হাইকোর্টে সম্পূরক আবেদন করা হলে হাইকোর্ট ২০১১সালের ১ ডিসেম্বর পৃথক রুল জারি করেন।প্রধান বিচারপতি রিট আবেদনটি নিষ্পত্তির জন্য তিন সদস্যের একটি বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করে দেন।২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখ বেঞ্চে রুলের ওপর শুনানির জন্য কার্যতালিকাভুক্ত হয় এবং ২৮ মার্চ ২০১৭ মহামান্য আদালত রিটটি খারিজ করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখেন।
এ রায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ধর্মীয় আবেগের প্রতি লক্ষ রাখা হয়েছে মাত্র।ঐরায়ে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও ইসলামি শরয়ী বিধান বাস্তবায়নের জন্য কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি।তবুও ঐতিহাসিক রায়ে যে আওয়ামী লীগ সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা কাজ করেছে, তা বলা বাহুল্য। কেননা আমরা জানি, সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রায় দেওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করে। কিন্তু ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ ও ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ রেখেই সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করা হয়। এ ছাড়া সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপিকে চেয়ারম্যান করে সংবিধান সংশোধনের জন্য একটি সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটিও ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ ও ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ রেখেই সংবিধান সংশোধনের সুপারিশ পেশ করে। ২০১১ সালের ২৫ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্মসংশ্লিষ্ট সংবিধানের ২(ক) অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয়। এতে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সম-অধিকার নিশ্চিত করিবে।’
জানা যায়,মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশনায় পঞ্চদশ সংশোধনীতে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ রাখা হয়। এ জন্য আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও হৃদয় নিংড়ানো অভিবাদন জানাই।
কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানের ২ক অনুচ্ছেদে স্থান পেলেও তার বাস্তবায়ন পরিলক্ষিত হচ্ছে না।তাই সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২ক রাষ্ট্রধর্ম চিরাচরিতই অবহেলিত।
লেখক,
মুহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত ত্বোহা
সংগঠক ও প্রাবন্ধিক
শিক্ষার্থী,আইন অনুষদ,ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল-tohaarafat1998@gmail.com

Mobile-01781704368

Comments

Unknown said…
প্রায় ৯০% ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের দেশে ইসলাম রাষ্ট্র ধর্ম হবে সেটাই স্বাভাবিক, তবে সংবিধানে পূর্বে কেন উল্লেখ ছিল না সেটা ভেবেই খারাপ লাগছে।
যাইহোক সংবিধানের ২ক অনুচ্ছেদ অবহেলিত না রেখে কার্যকর করা হোক সেটাই চাওয়া।
ইসলাম রাষ্ট্র ধর্ম হলেও এদেশে অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষরাও শান্তিতে, সমঅধিকার নিয়ে বাস করবে।এটাও ইসলামের শিক্ষা।