ছোট গল্প -"ইদ - আনন্দ অশ্রু"

 


সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছি বন্ধু সৃজনদের বাড়ি।সৃজন আমার বাল্যবন্ধু, স্কুলের বন্ধু, এখন আবার কলেজের বন্ধু। শরীর টা যেন আর চলছে না।সেই সকাল থেকে গোরু জবাই,গোশত কাটা, সব পরিষ্কার করা, প্রতিবেশীদের বাসায় গোশত  দিয়ে আসতে আসতে বেলা শেষ।  গোসল সেরে না খেয়েই সৃজনদের বাসায় আসার জন্য বের হচ্ছিলাম। মা তাড়াতাড়ি ভাত আর মাংসের তরকারি বেড়ে খাওয়ার জন্য জোর করে কিন্তু দেরি হয়ে গেছে তাই ভাত না খেয়ে দু টুকরো মাংস খেয়েই বেরিয়ে পরলাম। এখন দেখি ক্ষুধাও লেগেছে। এসব  ভাবতে ভাবতে সৃজনদের বাসার গেটে এসে পরলাম। আংকেল দেখতে পেয়ে গেট খুলে দিলেন। আংকেল এর মুখটা কেমন মলিন দেখাচ্ছে,অবশ্য তা তো দেখাবেই। প্রতি বছর ওরা কুরবানি দেয় কিন্তু এইবার দেয় নি। করোনার জন্য আংকেল এর স্কুল, টিউশন সব বন্ধ। সৃজনের কাছে শুনেছিলাম ২ মাস যাবত নাকি বেতন ও ঠিকমতো পায় নি। যার কারণে এইবার আর ওদের কুরবানি দেয়া হয় নি। তাই মা-বাবা আমাকে পাঠিয়ে দিলো ওদের বাড়িতে মাংস দিয়ে আসতে। দরজা দিয়ে ঢোকার সময় সৃজনের ছোট্ট বোন ছড়া দৌড়ে আসল, "সূর্য ভাইয়া, তুমি কেমন আছো? "

আমি ওকে কোলে তুলে নিয়ে বললাম" ভালো আছি আপু।" পকেট থেকে চকলেট বের করে দিলাম।ওর জন্য চকলেট আনা আমার অবশ্য কর্তব্য। ছড়াকে নামিয়ে সৃজনের রুমে ঢুকে দেখি বন্ধু আমার মন খারাপ করে বসে আছে।

"কিরে সৃজন,তোকে যে বললাম নামায শেষে ছড়াকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসবি। কই আসলি না কেন?"

", তুই।কখন আসলি? শরীর টা একটু খারাপ ছিল,তাই যাই নি।"

"আচ্ছা,তাই নাকি।তো দুপুরে খেয়েছিস?"

"হ্যাঁ, খেয়েছি।"

"কি দিয়ে খেয়েছিস?"

বন্ধু আমার একটু ইতস্তত করে জবাব দিল,

" কুরবানির ইদে মানুষ কি দিয়ে খায় জানিস না। আমিও তাই দিয়ে খেয়েছি,গোরুর মাংস দিয়ে খেয়েছি।"

কাকিমা দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। কাকিমার সাথে কথা কথা বলতে বলতে  সৃজনের  ডান হাতটা ওর অগোচরে নাকের সামনে নিয়ে ধরেছি,সেই চিরচেনা মুরগির মাংসের তরকারির ঘ্রাণ। ঘ্রাণটা আমার অপরিচিত নয়। আগে কয়েকবার আমি কাকিমার হাতের মুরগির মাংসের তরকারি খেয়েছি।

"কিরে সৃজন, তুই আমাকে মিথ্যা বললি কেন? তুই কি ভেবেছিস যে আমি বুঝতে পারব না তুই মুরগির মাংস খেয়েছিস।"

সৃজন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম,

" দোস্ত, তুই এখনও আমাকে চিনতে পারিস নি। মা তোর আর ছড়ার জন্য কুরবানির গোশত রান্না করে পাঠিয়েছে।  ইদের দিন আমরা গোরুর গোশত খাব আর তোরা কুরবানি দেস নি বলে খাবি না, তাই কি হয় নাকি।আর কাচা মাংস পাঠিয়েছেপরে কাকিমা রান্না করে দিবে।" কাকিমার দিকে তাকিয়ে দেখি সে আঁচল দিয়ে চোখ মুচছেন। আমি বললাম,

"কাকিমা সৃজন আর ছড়াকে অল্প করে ভাত দেন। টিফিন বক্সে তরকারি আছে। সাথে আমাকেও অল্পকরে  দিয়েন।দুপুরে ভাত খাই নি,ক্ষুধা লেগেছে। আমাকে কিন্তু আপনার রান্না করা তরকারি দিয়ে দিবেন।আপনার চিকেন রান্না করা তরকারির স্বাদ আমার দারুণ লাগে।"

আমার কথা শুনে কাকিমা হেসে বললেন,

" আচ্ছা বাবা, দিচ্ছি। তোমরা টেবিলে গিয়ে বস। আমি এক্ষুনি দিচ্ছি। "

আমরা তিনজন টেবিলে বসে খাচ্ছি। হঠাৎ ছড়া বলে উঠলো,

" সূর্য ভাইয়া, তুমিই বল কুরবানির ইদে কি মুরগির মাংস দিয়ে খেলে কুরবানির ইদ হয়? "

"না আপু, হয় না তো। এইজন্যই গোরুর গোশত এসে গেছে। এখন কি ইদ ইদ মনে হচ্ছে? "

"হ্যাঁ, সূর্য ভাইয়া।  মনে হচ্ছে।"

তাকিয়ে দেখি কাকিমা আর সৃজন আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে আমি সৃজনকে বললাম,

"সারাদিন তো মনে হয় কোথাও বের হোস নি,চল বিলের পাশে গিয়ে বসি।সন্ধ্যা হলে তুই বাড়ি চলে আসবি আর আমিও বাসায় চলে যাব।"

অতঃপর  আমরা বিলের পাশে এসে বসলাম। একটু পরেই সূর্য ডুববে। বিলের পানিতে তার রঙিন ছায়া পরেছে। সৃজন বলতে শুরু করল,

" জানিস সূর্য আজকে বাবার মনটা খুব খারাপ ছিল। ছড়া বারবার বলছিল কুরবানির মাংস দিয়ে ভাত খাবে।কিন্তু.."

আমি সৃজনকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,

" চুপ সৃজন। এইসব কথা বাদ থাক। দেখ কি সুন্দর গোধূলি । এখনি সূর্য টা পানিতে ডুববে।"

ও অবাক চোখে  সূর্যের দিকে তাকিয়ে  দৃঢ় কণ্ঠে বলল,

" সূর্য কখনো ডুবে না"

বলেই শান্তভাবে বিলের উপর ডুবন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি মুগ্ধ হয়ে সৃজনকে দেখছি। ওর চোখের কোণায় অশ্রু। মৃদু আলোয় কি মায়াবী দেখাচ্ছে ওর মুখটা।

আমার চার বছর আগের কথা মনে পরে গেল। কুরবানির ইদের প্রায় ২০ দিন আগে বাবার রোড এক্সিডেন্ট করায় কুরবানির জন্য রাখা সব টাকা বাবার চিকিৎসায় খরচ হয়ে যায়। ওইবার আর কুরবানির গোরু কিনা হয় নি,কুরবানিও দেয়া হয় নি। সেই বার এমনই এক বিকেলে কুরবানির গোশত নিয়ে সৃজন এসে হাজির হয় আমাদের বাসায়। কথাগুলো মনে হওয়ায় চোখে পানি এসে গেল। আমি জানি আমাদের দু জনের অশ্রুই আনন্দ অশ্রু। ইদ মানে যে আনন্দ। আর মনে মনে ভাবলাম যতদিন পৃথিবীতে সৃজন আছে ততদিন সূর্য ডুববে না।

রচনাকাল : ২০২০ সাল।

লিখেছেন: স্নেহের চন্দ্রপ্রভা

Comments