আদালত পাড়ার স্মৃতিময় আলাপন।

আদালত পাড়ার স্মৃতিময় আলাপন।


আপনার জীবন গল্প উপন্যাসে স্থান হোক কিন্তু উপন্যাস যেন জীবন না হয়। উপন্যাসের পাতায় চোখ বুলানোটা সহজাত বৈশিষ্ট্যে পরিণত বিধায় যত্রতত্র উপন্যাসে বুদ হয়ে থাকা অভ্যাস। জীবনে শত শত উপন্যাস পড়লাম কিন্তু উপন্যাসের বাস্তব চরিত্রের সঙ্গে খুব কমই সাক্ষাৎ হয়েছে। ইদানীং বিশেষত কারণে বই পড়ার সুযোগ হয় না। তবে প্রতিনিয়ত পড়ছি বাস্তব জীবনে ঘটমান উপন্যাস। 



ভার্সিটিতে লিগ্যাল ড্রাফটিং কোর্সে আইন পেশায় আইনজীবীর দক্ষতা ও নান্দনিকতা বিষয়ক লেকচারে কোর্স কনসালটেন্ট উদ্বৃতি দিয়ে বলেছিলেন, ”আইন পেশা এক মহান শৈল্পিক পেশা। এই পেশার পেশাজীবীর প্রতিটা দিন এক একটা উপন্যাস”।  তখন লেকচার শুনে বিমোহিত হয়েছিলাম। এলএলবি অনার্সের গন্ডি পেরিয়ে বর্তমানে প্রেকটিসিং লাইফে এসে দেখছি বিজ্ঞ সিনিয়রের প্রতিটা দিনই এক একটা মহাকাব্য যেন। 


ক্ষুদে লেখক হিসেবে টুকটাক লেখালেখি করতে বসলে তার আগে টেবিল ওয়ার্ক করতে হয়। কিন্তু এখন আর টেবিল ওয়ার্কের প্রয়োজন হয় না বরং নিজেদের প্রতিটা দিনের ক্লায়েন্ট ইন্টারভিউ সাপেক্ষে ফেক্ট গুলো মার্শালিং করলেই সেগুলো এক একটা উপন্যাসে পরিণত হয়। আমার বিশ্বাস বিজ্ঞ সিনিয়রের মোকদ্দমার ফাইলে স্থান পাওয়া ফ্যাক্টগুলো সাজিয়ে গল্পাকারে লিখলে সে গল্পের বই বাংলার একুশে বই মেলায় বেস্ট সেলার বই হবে। লার্নেডের ফাইলে সাজানো আরজি-জবাবে ফুটে উঠে এদেশের অসহায় মানুষের আর্তনাদের গল্প, বর্ণিত হয় অধিকার বঞ্চিত নারীর করুণ কাহিনী, মা-বাবার স্নেহ বঞ্চিত নাবালক শিশুর হৃদয় চুরমার করা আলাপন। অসহায় মানুষ গুলোর ইন্টারভিউ নিতে গেলে আমাদের চোখে আসে জল। আইনজীবীর ফি নিয়ে চিন্তা না করে বিজ্ঞ সিনিয়রের নিজ খরচেই লড়তে হয় অধিকার আদায়ে। কষ্ট লাঘব হয় যখন বিজ্ঞ আদালতের মাধ্যমে অসহায় মানুষ ফিরে পায় তার অধিকার। আপোষহীণ হয়ে অধিকার আদায়ে একজন জাঁদরেল আইনজীবী ও জাত মানবাধিকার কর্মীর অনন্য উদাহরণ হয়ে আছেন তিনি। ঠিক এভাবেই বিজ্ঞ লার্নেডের আইন পেশায় তিন দশক পেরিয়ে চতুর্থ দশক চলমান।


 

একজন মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে এক বা একাধিক সংসার থাকে।  সে সংসারের সকল সদস্যকে ভালো রাখতে দেখভাল করার দায়িত্বটা কর্তার উপরই বর্তায়। আর একজন আইনজীবীর ব্যক্তিগত জীবন বলতে তেমন কিছু থাকেনা। তার পেশাগত জীবনটাই ব্যক্তিগত জীবনে পরিণত হয়। আইনজীবীর যত ক্লায়েন্ট ঠিক ততটাই তার পরিবার। মামলার শুনানীতে আইনজীবীকে ক্লায়েন্টের ব্যক্তিসত্ত্বা হয়ে ক্লায়েন্টের বক্তব্য উপস্থাপনায় 'আমি' শব্দ উচ্চারণ করতে হয়। এই ‘আমি’  শব্দ দ্বারাই প্রতিটা ক্লায়েন্টের পরিবারকে ভালো রাখার গুরু দায়িত্বটা পরোক্ষ ভাবে আইনজীবীর উপরই বর্তায়। 


আইনজীবী সকলকে ভালো রাখতে গিয়ে নিজেকে ভালো রাখার কথাই ভুলে যান। রাত তিনটা বাঁজেও ক্লায়েন্ট ফোন দিয়ে দুঃখের গল্প শোনায়। শোনায় নির্মমতার ইতিহাস।  করুণ কাহিনী শুনে আইনজীবীর রাত যায় নিন্দ্রাহীন।  চিন্তার জগতে ঢেউ খেলে ক্লায়েন্টকে ভালো রাখার গ্রাউন্ড সমূহ। আবার যখন ক্লায়েন্ট যত্রতত্র ফোন দিয়ে, মেইল করে, সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে সুখের সংবাদ দেয় তখন আইনজীবীর সেই মুহূর্তটা হয় স্বর্গীয়ক্ষণ। 


সর্বশেষ গত ২৪ই জানুয়ারি ২০২৩ ইংরেজি তারিখের দিনটি ছিলো আমাদের মহাকাব্যিক দিন। সন্তানের কাস্টডি ও শরীরের অভিভাবকত্বের মোকদ্দমায় প্রতিপক্ষ তথা বাদীকে জেরা করতে গিয়ে বেরিয়ে আসলো এক অবলা মেয়ের আর্তনাদের গল্প। ফুটে উঠলো শন্ডা প্রকৃতির বহু নারী আসক্ত এক কুখ্যাত পুরুষের ব্যক্তি চরিত্র। চরিত্রহীনা বলে স্ত্রীকে মারধর পূর্বক তাড়িয়ে দেয়া এবং পরোক্ষণে চরিত্রহীনা বলে মামলাকারী স্বামী নিজেই যখন জেরায় স্ত্রীকে সতীসাধ্বী বলে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হোন এবং মোকদ্দমার আরজি থেকে স্ত্রীর নামের সহিত চরিত্রহীনাসহ ইত্যাদি নেতিবাচক শব্দ মুছে দেয়া হয় তখন সেই ভুক্তভোগী স্ত্রীর আনন্দের অশ্রু আমাদের চোখেও আনন্দ জল নিয়ে আসে। আদালতে উপস্থিত প্রতিটা ব্যক্তি চোখে জল নিয়ে ছলছল করে তাকিয়ে থাকে সে মেয়েটির দিকে।


সন্তান জন্মদানে শুক্রাণু দিয়ে সহযোগিতা করলেই যে বাবা হওয়া যায় না তার জলজ্যান্ত উদাহরণটুকুও দেখার সুযোগ হয়েছে। সন্তানের জন্ম থেকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো সময় এমনকি তার পরবর্তী সময়েও পিতা হিসেবে খোঁজ না নেয়াটা কেমন পিতার বৈশিষ্ট্য তাহা সংজ্ঞায়ন করার শব্দাবলী অভিধানেও পাওয়া মুশকিল। মাঝেমধ্যে দূরের লোক থেকে সন্তানের খোঁজ নেয়া সেই বাবা যখন আবার সন্তানের কাস্টডি ও শরীরের অভিভাবকত্বের দাবি করে মোকদ্দমা দায়ের করেন তখন বিষয়টি শিশুকিশোর মাসিক পত্রিকা কিশোরকণ্ঠের হাসির বাক্সে পরিণত হয়। 


লার্নেড সিনিয়র যখন জেরায় বাদীকে তথা স্বামীকে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা আপনি আপনার স্ত্রীকে চরিত্রহীনা বলে দাবি করেছেন এবং তাহা বলিয়া মামলাও দায়ের করেছেন, তো আপনি কিভাবে শিউর হলেন এই সন্তান আপনার? যেহেতু আপনার স্ত্রী চরিত্রহীনা সেহেতু এই সন্তানতো যারতার হতে পারে। এই প্রশ্নে চরিত্রহীনা দাবি কারী স্বামী যেমন ভ্যাবাছ্যাকা খেয়েছেন তেমনি কোর্টে উপস্থিত প্রতিটা লইয়ারও শিউরে উঠেছেন। প্রশ্ন শুনে বিচারকতো নিস্তব্ধহীন হয়ে ছলছল করে তাকিয়ে ছিলেন। পিছন থেকে কতেক আইনজীবী ও দর্শক বলতেছিলেন, "ইট’স কলড ল'ইয়ার অ্যান্ড ইট’স কলড এক্সামিনেশন"। প্রশ্নের উত্তরে মিথ্যুক স্বামী খুব সাধারণ ভাবেই স্বীকার করে নিয়েছেন তাহার স্ত্রী সতীসাধ্বী আর এই সন্তান তাহার ঔরসে এবং তাহার স্ত্রীর গর্ভে জন্মে নিয়েছেন। মাননীয় বিচারক জেরার প্রশ্ন ও উত্তরের নোট নিতে গিয়ে আবেগী হয়ে তাকিয়ে ছিলেন আনমনা । বিজ্ঞ বিচারক লার্নেডের বরাবরে সন্তুষ্টির দৃষ্টিতে ঝলক তাকিয়ে ছিলেন। কিভাবে এক প্রশ্নেই মোকদ্দমার সত্যতা বেরিয়ে আসলো তাই ভাবছিলেন উপস্থিত জনতা।  সেই এক প্রশ্নেই মোকদ্দমার গ্রাউন্ড হারিয়ে গেলো। মোকদ্দমা সম্পূর্ণ রূপে বিবাদী তথা অবলা স্ত্রীর অনুকূলে স্থান নিলো। এখন শুধু চূড়ান্ত রায় শোনার অপেক্ষায়।  তবে তজ্জন্য আদালতের নিয়মতান্ত্রিকতায় ব্যয়িত সময়টুকু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। 


২৪ই জানুয়ারী ২০২৩ ইংরেজি তারিখে  আদালতে ব্যয়িত সময়টুকু আমার স্মৃতির জগতে সর্বদা চেতন হয়ে থাকবে। বারবার মনে পড়বে বিচারকের কিংকর্তব্য বিমূঢ় আবেগী হয়ে থাকা চেহারাটুকু। সম্মুখে ভেসে আসবে পাষান্ড স্বামীর চোরা চোরা ভাবের মুখ অবয়ব ও বাদী পক্ষের আইনজীবীর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা দৃশ্য। স্মতিপটে আসবে ভেসে ভুক্তভোগী স্ত্রীর উজ্জ্বল চেহারাখানা এবং প্রতিটা দর্শকের সন্তুষ্টির হাসি।


লেখক,

মুহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত ত্বোহা

কলামিস্ট ও লিগ্যাল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট,

চেম্বার অব ড.দিলরুবা সরমিন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট।

Comments